নারী-চরিত/রাজ্ঞী মেরিয়া থেরিসা

উইকিসংকলন থেকে

রাজ্ঞী মেরিয়া থেরিসা।

 ১৭১৭ খৃষ্টাব্দে বোহেমিয়া ও হঙ্গেরী প্রদেশের অধীশ্বরী সুবিখ্যাত রাজ্ঞী মেরিয়া থেরিসার জন্ম হয়। ইনি সম্রাট্‌ ষষ্ঠচার্‌র্লসের কন্যা। সম্রাট্‌ চার্‌র্লসের একটী পুত্র ছিল; পুত্রটী অল্প বয়সে কালগ্রাসে পতিত হয়। অনন্তর সম্রাটের মৃত্যু হইলে, তদীয় এক মাত্র উত্তরাধিকারিণী কন্যা মেরিয়া থেরিসা ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে পিতৃ সিংহাসনে অধিরূঢা হন। তিনি রাজ্যেশ্বরী হইলে প্রতিবেশী রাজগণ, হিংসাপরতন্ত্র হইয়া একেবারে চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহাকে আক্রমণ করিল। সুতরাং রাজধানী বিএনা নগরে বাস করা তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। তখন কি করেন অগত্যা রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিলেন। অবশেষে হঙ্গেরি প্রদেশে উপস্থিত হইয়া, তথাকার প্রজাদিগকে আহ্বান করিলে, তাহারা সকলে রাজ্ঞী সমক্ষে সমবেত হইল। রাজ্ঞী থেরিসা আপন ক্রোড়দেশে শিশুসন্তানকে লইয়া হীনবেশে ও স্নানমুখে তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘‘হে প্রজানিকর! দেখ, আমি দুর্ভাগ্যবশতঃ আত্মপরিজন কর্ত্তৃক ত্যক্ত ও প্রবল শত্রু দ্বারা তাড়িত হইয়া তোমাদিগের শরণাগত হইয়াছি; এক্ষণে তোমাদিগের বীরত্ব প্রভাব ও আমার একান্ত অধ্যবসায় ব্যতীত শত্রু দমনের দ্বিতীয় উপায় নাই। এই শিশু রাজকুমারকে তোমাদিগের হস্তেই সমর্পণ করিতেছি, যাহাতে ইহার জীবন রক্ষা ও উত্তরকালে রাজ্যপ্রাপ্তি হয়, তদ্বিষয়ে সবিশেষ যত্ন করা তোমাদিগের অতীব কর্ত্তব্য”।

 রাজ্ঞীর মলিন ভাব ও সুমধুর বচন চাতুরীতে হঙ্গেরীবাসী প্রজাপুঞ্জ সাতিশয় স্নেহ পরবশ হইয়া নিরতিশয় দুঃখিত হইল ও তাঁহাকে স্বরাজ্যে পুনঃস্থাপন জন্য ব্যস্ত হইয়া আপন আপন কোষ হইতে তরবারি বহির্গত করিয়া সকলে এক বাক্যে প্রতিজ্ঞা করিল, যে, ‘‘আমরা রাজ্ঞী মেরিয়া থেরিসার নিমিত্ত প্রাণ পর্য্যন্ত সমর্পণ করিয়া রাজ্য রক্ষা করিব’’।  পরক্ষণেই চতুর্দ্দিক হইতে সহস্র সহস্র সৈন্য সংগ্রহ হইতে লাগিল। ভদ্রবংশীয় বীর পুরুষেরা স্বেচ্ছাপূর্ব্বক সেনানীর পদ গ্রহণ করিয়া অবিলম্বে সমরক্ষেত্রে অবতরণ পূর্ব্বক তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ করিল। ইংলণ্ড ও সার্ডিনিয়া রাজ্যের ভূপতিরা স্ব স্ব সৈন্য প্রেরণ দ্বারা সাহায্য করিতে লাগিল। রাণী মেরিয়া থেরিসা, আপন সুগভীর বুদ্ধিবলে অল্পকাল মধ্যে, রাজ্যের কয়েকটী প্রধান প্রধান স্থান হস্তগত করিলেন। এই সমরানল ক্রমাগত আট বৎসর প্রজ্জ্বলিত ছিল, পরে ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে সন্ধি দ্বারা নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইলে রাজ্ঞী পুনরায় স্বরাজ্য প্রাপ্ত হন। তিনি শত্রু সমূহ হইতে রাজ্য উদ্ধার করিয়া, যুদ্ধ কার্য্যে যাহা ক্ষতি হইয়াছিল, প্রথমেই তাহার পূরণে প্রবৃত্তা হইলেন।

 অনন্তর শিল্প ও বাণিজ্য কার্য্যের উন্নতি চেষ্টায় যত্নবতী হইয়া ট্রীষ্টী ও টীয়র্স নগরে সর্ব্বদেশীয় বণিকদিগকে বাণিজ্য করিবার অনুমতি প্রদান করিলেন। রাজধানী বিএনা নগরের আয়তন বৃদ্ধি করিয়া প্রতি পল্লিতে নানাবিধ বাণিজ্যদ্রব্যের নির্ম্মাণোপযোগী কুঠি স্থাপন করিয়া বণিক্‌সমূহের কার্য্যের সুবিধা করিয়া দিলেন। বিদেশীয় বণিক্‌ দলের সমাগমে বিএনা নগরের পথ ঘাট পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল ও ভারতবর্ষ প্রভৃতি পূর্ব্ব রাজ্যের সহিত প্রশস্ত রূপে বাণিজ্য আরম্ভ হইল।

 রাজ্ঞী থেরিসা, কেবল বাণিজ্য বিষয়ের উন্নতি সাধন করিয়া ক্ষান্ত হইলেন না। তিনি প্রজাগণের বিদ্যালাভের নিমিত্ত, রাজ্যের সমস্ত প্রদেশে অসংখ্য চতুষ্পাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থাপিত করিলেন, তন্মধ্যে বিএনা নগরে স্বনামে নামকরণ পূর্ব্বক যে প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন, তাহাতেই তাঁহার যার পর নাই এক প্রধান কীর্ত্তি রহিয়া গিয়াছে। ইহা ভিন্ন ঐ নগরে চিত্রশালিকা, প্রেগ্‌ ও ইনস্‌প্রাগ্‌ নগরদ্বয়ে প্রকাশ্য পুস্তকালয় এবং বিএনা, গ্রেজ্‌ ও টিয়র্নন্‌ নগরে তিনটী পর্য্যবেক্ষণিকাগৃহ স্থাপন করিয়া বিদ্যার্থিবর্গের মহৎ উপকার সাধন করেন। বিশেষতঃ সৈনিকদিগের চিকিৎসার জন্য সমধিক প্রযত্নে স্থানে স্থানে চিকিৎসালয় ও অনাথনিবাস নির্ম্মাণ এবং সেনাপতিদিগের বিধবাপত্নী ও হৃতসর্ব্বস্ব ভদ্র মহিলাগণের জীবিকা নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়া দুরবস্থাপন্ন প্রজাগণের দুঃখ শান্তির উপায় করিয়া দেন।

 বিএনা নগরের শোভার আর পরিসীমা রহিল না; সকল দিকেই অপরূপ স্ফটিকবৎ শ্বেতবর্ণ অট্টালিকা, সুপ্রশস্ত রাজপথ, অপূর্ব্ব পণ্য দ্রব্য পূর্ণ বাণিজ্যালয়, ছাত্রপূর্ণ বিদ্যামন্দির, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পর্য্যবেক্ষণিকাগৃহ, অনাথ ও রুগ্নদিগের শান্তিময় অনাথনিবাস ও চিকিৎসালয় প্রভৃতি নয়নগোচর হওয়াতে নগরের এক প্রকার অভূতপুর্ব্ব শোভা ও মহিষীর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রদান করিতে লাগিল। বস্তুতঃ তিনি যে এক স্ত্রীরত্ন ছিলেন তাহা তদীয় কীর্ত্তিকলাপ দ্বারাই পৃথিবীর সকল জনপদে পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল।

 ১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে তদীয় রাজ্যে পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল; এই যুদ্ধ কএক বৎসর পর্য্যন্ত একাদিক্রমে থাকিয়া অবশেষে সন্ধি দ্বারা নিষ্পত্তি হয়। তাহাতে রাজ্ঞীর একটী বিশেষ উপকার লাভ হইয়াছিল, অর্থাৎ তাঁহার পুত্র যুসফ্‌ রোমরাজ্যের সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলেন। পর বৎসর দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহার প্রিয়তম স্বামির পরলোক প্রাপ্তি হওয়াতে, রাজ্ঞীর আর শোকের ইয়ত্তা রহিল না, প্রতিনিয়ত হাহাকার শব্দে রোদন করিয়া উন্মত্তাপ্রায় হইলেন। পতির মৃত্যু দিবসে তিনি যে শোকসূচক কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদ পরিধান করিয়াছিলেন, তাহা আজীবন কাল পরিত্যাগ করেন নাই। রাজ্ঞী স্বামির এরূপ প্রণয়িনী ছিলেন, যে স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁহার প্রণয় বিস্মৃত হইতে না পারিয়া প্রতিমাসে এক এক বার তদীয় সমাধি স্থলে উপস্থিত হইয়া আর্ত্তনাদ করিতেন।

 ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে, তিনি প্রুসিয়ার অধিপতি ও রুসিয়া রাজ্যের মহিষীর সহিত একত্রিত হইয়া পোলণ্ড রাজ্য অধিকৃত করিতে যত্নবতী হইলেন ও সাত বৎসর কাল পরে তৎপ্রদেশ হস্তগত করিয়া আপনাদিগের মধ্যে বিভাগ করিয়া লইলেন।

 রাজ্ঞী মেরিয়া, চিরজীবন স্বদেশের উন্নতিচেষ্টায় থাকাতে, সকলের নিকট বিপুল সম্মান লাভ করেন। তিনি আপন বাহুবলে অষ্ট সন্তানকে ইউরোপের অন্তর্ব্বর্ত্তী ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের অধীশ্বর করাতে রাজগণ মধ্যে বিশেষ প্রতিষ্ঠা ভাজন হন। পরিশেষে ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে উৎকট পীড়াগ্রস্ত হইয়া মানব লীলা সংবরণ করেন। তাঁহার মৃত্যুতে কি দীন, কি দুঃখী, কি ধনী, সকল লোকই শোক প্রকাশ করিয়াছিল। তিনি এরূপ দয়াশীলা ছিলেন যে অন্তিম কালেও দীন দুঃখী ও নিরাশ্রয় ব্যক্তিদিগের সমধিক উপকার সাধন করিয়া গিয়াছেন। তিনি যাবজ্জীবন পরোপকার ব্রতে অনুরক্ত ছিলেন বলিয়া, মৃত্যুকালে তাঁহার আর আনন্দের পরিসীমা ছিল না। মৃত্যুর ক্ষণকাল পূর্ব্বে প্রসন্ন বদনে কহিয়াছিলেন, ‘‘যে যত দূর পর্য্যন্ত আমার স্মরণ হয়, কখন কাহার উপকার ভিন্ন অপকার করি নাই; আমি মৃত্যু শয্যায় শয়ন করিয়া, ইহা স্মরণ করতঃ অসীম সন্তোষ লাভ করিতেছি’’।

 দেখ! মেরিয়া থেরিসা, এক জন মহাপ্রতাপশালী রাজকন্যা ছিলেন, সুতরাং তাঁহার কিছুরই অভাব ছিলনা। রাজকন্যারা যেরূপ আমোদ প্রমোদের বশবর্ত্তিনী হইয়া আলস্যে কাল হরণ করেন, তিনি সে রূপ ছিলেন না, শৈশবকালেই অনেক যত্নে বিদ্যা শিক্ষা করিয়া, পরিশেষে স্বদেশের কি পর্য্যন্ত উপকার না করিয়াছিলেন। স্ত্রীলোক হইয়া এক জন পরাক্রমশালী ভূপতির ন্যায় শত্রুদমন ও স্বদেশের হিতসাধন সহকারে কেমন সুশৃঙ্খলরূপে রাজকার্য্য সমাধা করিতেন। বীর পুরুষের ন্যায় আপন বাহুবলে রাজ্য উদ্ধার করিয়া লোক সমাজে যশস্বিনী হইয়াছিলেন। কথিত আছে, একদা পরোপকারিণী থেরিসা, সম্রাট্‌ চার্‌র্লসের নিকট প্রকাশ করিয়াছিলেন, যে, তিনি কেবল স্বদেশের উপকার সাধনের জন্য সুকঠিন রাজ্য ভার গ্রহণ করিবেন। বস্তুতঃ তাহা মিথ্যা নহে। তাঁহার প্রতি মুহূর্ত্তই কোন না কোন পরোপকার কার্য্যে অতিবাহিত হইত।

 কোন সময়ে এক জন সামান্য সেনার পীড়া হইলে তিনি তাহাকে আপন শকটারোহণ করাইয়া স্বস্থানে লইয়া যাইতে ভৃত্যদিগকে অনুমতি করিলেন। ভৃত্যেরা ক্ষণকাল মধ্যে প্রতিগমন করিয়া কহিল, রাজ্ঞি! এই পীড়িত ব্যক্তি অতি দীনহীন এবং অতিশয় মাতৃভক্তিপরায়ণ; মাতাকে দূববস্থায় পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে বলিয়া, সেই দুঃসহ ভাবনায় এরূপ কঠিন পীড়াগ্রস্ত হইয়াছে।

 রাজ্ঞী মেরিয়া ভৃত্যের প্রমুখাৎ সৈনিক পুরুষের এবস্প্রকার মাতৃভক্তির কথা শ্রবণ করিয়া, তাহার উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন, ও লোক দ্বারা তাহার মাতাকে রাজধানীতে আনয়ন করিয়া অতি বিনীত ভাবে কহিলেন, মাতঃ! তোমার প্রতি তদীয় সন্তানের অসাধারণ ভক্তি দেখিয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি, এক্ষণে তাহাকে তোমা হইতে স্বতন্ত্র রাখিতে অভিলাষ করি না। রাজকোষ হইতে তোমাদিগের বৃত্তি নির্দ্ধারিত করিয়া দিতেছি, তুমি গৃহে বসিয়া সুখ সচ্ছন্দে জীবনের অবশিষ্ট কাল অতিবাহিত কর এবং তোমার পুত্রও মাতার সেবা শুশ্রুষা করিয়া লোকসমাজে মাতৃভক্তির অসাধারণ উদাহরণ প্রদর্শন করুক।

 রাণী মেরিয়া থেরিসা এই প্রকার অসংখ্য দীন দরিদ্রের দুঃখ মোচন করিয়াছিলেন। তিনি রাজকন্যা ও এক প্রকাণ্ড সম্রাজ্যের অধিশ্বরী হইয়াও নিরহঙ্কার ও নম্রস্বভাবা ছিলেন। সম্ভ্রান্ত ও দীন দুঃখী উভয়কেই সমভাবে আদর করিতেন, তাঁহার বিনীতভাবে সন্তুষ্ট হইয়া এক সামান্য কৃষক কহিয়াছিল, যে “যদিও আমি এই রাজ্যের একজন দুঃখী প্রজা, তথাপি যখন ইচ্ছা করি, রাজ্ঞীর সমক্ষে উপস্থিত হইয়া সম্ভাষণ করিতে পারি এবং তিনিও আমাকে এক জন সন্ত্রান্ত লোকের ন্যায় সমধিক যত্ন করিয়া আমার প্রার্থনা শ্রবণ করেন”।

 এক দিন রাজ্ঞী মেরিয়া থেরিসা কোন কার্য্যান্তর হইতে রাজপ্রাসাদে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, ইতিমধ্যে পশ্চাতে কাতরধ্বনি শ্রবণ করিয়া দেখিলেন, একটী দীন হীন স্ত্রী, দুইটী শিশু সঙ্গে লইয়া আহার প্রার্থনায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইতেছে। তিনি তাহাদিগের কাতরধ্বনি শ্রবণ ও মলিন ভাব দর্শন করিয়া অতিশয় ক্ষুন্ন হইয়া ভাবিলেন, আহা! এরূপ দীন হীন ব্যক্তিও আমার রাজ্যে বাস করে। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে বাটীতে লইয়া আসিলেন, ও আপনার ভোজনসামগ্রী তাহাদিগের মধ্যে বিভাগ করিয়া দিয়া বলিলেন, ‘‘ইহারা আমার সন্তান তুল্য, অবশ্য আমার ইহাদিগের দুঃখ মোচন করা কর্ত্তব্য’’। পরিশেষে যথেষ্ট অর্থদান দ্বারা সেই দুঃখী পরিবারের কষ্ট দূর করিলেন।