বিষয়বস্তুতে চলুন

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/পঞ্চম অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম অধ্যায়

‘যুক্ত-রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার যুগ

 ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ আমার ৮৯ বৎসর বয়সে আমেরিকার উত্তর দক্ষিণ প্রান্তে সন্ধি হয়। তাহার ফলে গোলামের জাতিকে স্বাধীন করিয়া দেওয়া হয়। তাহার পর হইতে ১৮৭৮ সাল পর্য্যন্ত দুই প্রান্তের শ্বেতকায় মহলে নানা বিষয়ে বুঝাপড়া চলিতে লাগিল। রাষ্ট্রশাসন সম্বন্ধে দুই অঞ্চলের লোকেরা মিলিয়া একটা রফা করিয়া লইলেন। যথার্থ ঐক্যবিশিষ্ট যুক্ত-রাষ্ট্র এই সময়ের মধ্যেই গড়িয়া উঠে। এই ১০।১১ বৎসর আমার ব্যক্তিগত জীবনের পক্ষেও অতি মূল্যবান সময়। কারণ এই সময়ের মধ্যে আমি আমার বাল্যজীবন অতিবাহিত করিয়া মানুষ হইবার পথে অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি। গোলামাবাদের আবহাওয়া ছাড়িয়া নব নব দুঃখ দারিদ্র্যের সংসারে বাড়িয়া উঠিয়াছি। হ্যাম্পটনে লেখা পড়া শিখিবার জন্য কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। তাহার পরে ম্যাল্‌ডেনে পরোপকার ও শিক্ষাপ্রচার কর্ম্মে ব্রতী হইয়াছি।

 এই যুগ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নিগ্রোজাতির ইতিহাসেও স্মরণীয় কাল। ইহাকে তাহাদের নবজীবনের শৈশব কাল বলিতে পারি। এই সময়ের মধ্যে তাহাদের হৃদয়ে নব নব আশা জাগিয়াছে তাহারা নূতন চোখে পৃথিবী দেখিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদের চিত্তে প্রথম হইতেই দুইটি ইচ্ছা স্থায়ী ঘর করিয়া বসিল। প্রথমতঃ গ্রীক ও ল্যাটিন শিখিবার জন্য তাহারা অত্যধিক লালায়িত হইল। দ্বিতীয়তঃ লেখাপড়া শিখিয়া সরকারের চাকরী পাইবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিল।

 বলাই বাহুল্য, যুগযুগান্তর ধরিয়া যাহারা গোলামী করিয়াছে তাহাদের পক্ষে বিদ্যালাভের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝা সহজ নয়। দক্ষিণ অঞ্চলের প্রত্যেক গ্রামেই অবশ্য অসংখ্য পাঠশালা খোলা হইতে লাগিল। দিবা-বিদ্যালয়, নৈশ-বিদ্যালয়, রবিবারের বিদ্যালয়, বালিকা বিদ্যালয় ইত্যাদি নানাবিধ বিদ্যালয়ে নিগ্রোসমাজ ভরিয়া গেল। স্কুলগুলি ছাত্র ছাত্রীতে পূর্ণ থাকিত। ৬০।৭০।৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধেরাও লেখাপড়া শিখিতে ছাড়িল না। শিক্ষা লাভের জন্য এত আগ্রহ দেখিয়া কাহার না আনন্দ হয়? কিন্তু একটা আশ্চর্য্যের কথা এই যে নিগ্রোমাত্রেই ভাবিতে লাগিল যে, আর তাহাদের হাতে পায়ে খাটিতে হইবে না, লেখা পড়া শিখিয়া তাহারা আফিসের কেরাণী অথবা বড় সাহেব হইতে পারিবে। মাথায় তাহাদের আর একটা খেয়াল ঢুকিল যে, গ্রীক ল্যাটিন ভাষায় দুই চারিটা বুকুনি না দিতে পারিলে পণ্ডিত হওয়া যায় না। এই সকল ভাষায় যাহারা কথা বলিতে পারে, তাহারা না জানি কোন্ অপূর্ব্ব জগতের লোক! এমন কি, আমারও এইরূপই অনেক সময়ে মনে হইত।

 লেখা পড়া শিথিয়া আমার স্বজাতিরা কেহ শিক্ষক, কেহ ধর্ম্মপ্রচারক হইতে লাগিলেন। কৃষিকর্ম্ম, শিল্প, ব্যবসায়, পশুপালন ইত্যাদি কার্য্যে মজুরের ন্যায় খাটিতে হয়। সুতরাং যথাসম্ভব সকলেই এই সকল কার্য্য বর্জ্জন করিতে প্রয়াসী হইল। বিদ্যাদানকেই জীবনের ব্রতস্বরূপ গ্রহণ করিতে অবশ্য খুব কম লোকই পারিত। প্রকৃত ভক্তভাবে ধর্ম্মগুরুর দায়িত্ব গ্রহণ করাও অনেকের পক্ষে অসম্ভব ছিল। তাহারা সহজে বিনা পরিশ্রমে বাবুগিরি করিয়া জীবন কাটাইবার জন্যই এই দুই দিকে ঝুঁকিয়া ছিল। যাহারা পণ্ডিতি করিতে চাহিত তাহাদের পেটে অনেক সময়ে তিল মাত্র বিদ্যা থাকিত কি না সন্দেহ। কেহ কেহ কোন উপায়ে নাম সহি করিতে শিখিয়াই মাষ্টারী খুঁজিত। আমার মনে আছে একবার এক ব্যক্তি একটা পাঠশালার চাকুরী চাহিতেছিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল,, “বল ত পৃথিবীর আকার কিরূপ? তুমি ছেলেদিগকে এ বিষয় কিরূপে বুঝাইবে?” সে তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “কেন মহাশয়, পৃথিবী গোলাকার বা চ্যাপ্টা এ সব জানিয়া আমার প্রয়োজন কি? স্কুলের কর্ত্তাদের ও সম্বন্ধে যাহা মত আমি তাহাই ছাত্রদিগকে শিখাইতে প্রস্তুত আছি।”

 এই গেল গুরুমহাশয়দিগের অবস্থা। ধর্ম্মপ্রচারকগণের অবস্থা আরও শোচনীয়। অত নিরেট মূর্খ ও কুসংস্কারপূর্ণ এবং চরিত্রহীন লোক বোধ হয় অন্য কোন ব্যবসায়ে দেখা যায় না। যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক সকলেই মনে করিত, “আমি ভগবান কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়াছি।” ধর্ম্ম প্রচার বিষয়ে ‘আদেশ’ বহু লোকেই পাইতে লাগিল! দুই তিন দিন স্কুলে আসিবার পর দেখিতাম ছাত্রেরা চলিয়া যাইতেছে। অনুসন্ধান করিলে বুঝা যাইত—তাহারা ‘আদেশ’ পাইয়া ধর্ম্মগুরুর কার্য্যে ব্রতী হইয়াছে। এই ‘আদেশ’ পাওয়া ব্যাপারটা বড়ই রহস্যজনক। গির্জাঘরে লোকজন বসিয়া আছে এমন সময়ে একব্যক্তি হঠাৎ মেজের উপর পড়িয়া যাইত। বহুক্ষণ নিষ্পন্দ অসাড় ও বাক্‌শক্তিহীন অবস্থায় থাকিত। অমনি পাড়ায় সাড়া পড়িয়া যাইত, অমুক ব্যক্তির ‘আদেশ’ হইয়াছে। তাহার পর হইতেই সে ধর্ম্মগুরু! এইরূপ ‘দশায়’ পড়া প্রায় প্রত্যেক নিগ্রোপল্লীতে প্রতি সপ্তাহেই দুই চারিটা ঘটিত। আমি এই ‘দশায়’ পড়া ব্যাপারটাকে বুজরুকি মনে করিতাম। আমার ভয় হইত পাছে আমিও বা কোন দিন দশায় পড়িয়া ভগবানের আদেশ পাইয়া বসি। আমার সৌভাগ্য আমি সেরূপ আদেশ পাইবার অবস্থা কাটাইয়া উঠিয়াছি।

 সমাজে ধর্ম্মগুরুর সংখ্যা যারপরনাই বাড়িতে থাকিল। একটা ধর্ম্মমন্দিরের কথা আমার মনে আছে—তাহার অন্তর্গত খৃষ্টধর্ম্মাবলম্বী লোক সংখ্যাই ছিল সর্ব্বসমেত ২০০ জন মাত্র। অথচ তাহার ধর্ম্মপ্রচারক সংখ্যাই প্রায় ২০। আজকাল নিগ্রোসমাজে ধর্ম্মের অবস্থা অনেকটা উন্নত হইয়াছে। দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জাতি যথেষ্ট নৈতিক শক্তি লাভ করিতেছে। ‘দশায়’ পড়া এবং ‘আদেশ’ পাওয়ার হুজুগ অনেক কমিয়া আসিয়াছে। আর ৩০।৪০ বৎসর পরে আমাদের আরও উন্নতি হইবে আশা করিতেছি।

 এখন ধর্ম্ম প্রচারের ব্যবসায়ে না লাগিয়া কৃষিকার্য্যে শিল্পকর্ম্মে ও পশুপালনে নিগ্রোরা মনোনিবেশ করিতে উৎসাহী হইতেছে। ইহা সুলক্ষণ। প্রকৃত চরিত্রবান্ সুশিক্ষিত ব্যক্তিগণ ধর্ম্মমন্দিরের কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছেন। শিক্ষক-সমাজেও যোগ্য শিক্ষাপ্রচারকের সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছে।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি ১৮৬৭ হইতে ১৮৭৮ সাল পর্য্যন্ত উত্তরে দক্ষিণে এক হইয়া জমাট বাঁধিতেছিল—প্রকৃত যুক্ত-রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিতেছিল। এই যুক্তরাষ্ট্রের শাসনবিচার-বিষয়ক সর্ব্ব প্রধান কর্ত্তৃপক্ষের নাম “ফেডারেল সরকার” বা ‘যুক্ত দরবার’। এই যুক্ত দরবারের নায়কতায়ই আমেরিকার গৃহবিবাদ শীঘ্র শীঘ্র ঘুচিয়া গিয়াছে। এই ফেডারেল সরকারের চেষ্টায়ই গোলামের জাতি স্বাধীনতা পাইয়াছে। এই ফেডারেল সরকারই এখন যুক্তরাষ্ট্রের নূতন শাসন-প্রণালী, নূতন বিচারপ্রণালী, ইত্যাদির ব্যবস্থা করিয়া নবীন রাষ্ট্রগঠনে বিশেষ উদ্যোগী।

 সুতরাং নিগ্রোরা এই যুক্ত দরবারের নিকট সকল অভাব অভিযোগের মীমাংসা আশা করিতে লাগিল। তাহারা ভাবিত যে ২০০ বৎসর নিগ্রোজাতি গোলামী করিয়া আমেরিকার ধন সম্পদবৃদ্ধির কারণ হইয়াছে। গোলামগণের রক্তেই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বল, শিল্প বল, ব্যবসায় বল সকলই পরিপুষ্ট হইয়াছে। নিগ্রোজাতিই যুক্তরাজ্যের সকলপ্রকার ঐশ্বর্য্য, সকল প্রকার সুখভোগ, সকলপ্রকার প্রতিষ্ঠা লাভের মূল কারণ। নিগ্রোজাতিকে কেনা গোলাম করিয়া না রাখিলে আমেরিকার সভ্যতা গড়িয়া উঠিতে পারিত না। আজ তাহারা নিগ্রোজাতিকে স্বাধীনতা দিয়াছে সত্য। কিন্তু ইহা নিগ্রোজাতির দুইশতবর্ষব্যাপী কঠোর পরিশ্রম স্বীকারের মূল্য ছাড়া আর কিছুই নয়। এখনও তাহারা যুক্তরাষ্ট্রের নিকট অনেক দাবী করিতে অধিকারী। কেবল আব্দার মাত্র নয়, জননীর নিকট বালকের ক্রন্দন ও প্রার্থনা মাত্র নয়, প্রভুর নিকট ভিক্ষা চাওয়া নয়, নিগ্রোজাতি যুক্তদরবারের নিকট তাহাদের ন্যায্য অধিকারের দাবী করিতেছে—তাহারা এইরূপই ভাবিত। আমিও অনেক সময়ে ভাবিয়াছি—যুক্তদরবার আমাদিগকে স্বাধীন করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন কেন? আমাদের প্রতি এই দরবারের কর্ত্তব্য, ইয়াঙ্কিজাতির কর্ত্তব্য, সমগ্র শ্বেতাঙ্গ সমাজের কর্ত্তব্য এই টুকুতেই কি শেষ হইয়া গেল—এই সামান্য কর্ম্মেই কি তাহারা আমাদের ঋণ শোধ করিয়া ফেলিল? আমি ভাবিতাম, যুক্তদরবারের আমাদিগকে স্বাধীন করিবার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগের উপযুক্ত করিয়া তুলিবার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এজন্য আমাদিগের সমাজে শিক্ষাবিস্তারের আয়োজন করাও তাহার কর্ত্তব্য ছিল।

 এইখানে আর একটা কথা বলিয়া রাখি। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনবিচারাদি কার্য্য দুই দরবারে নিম্পন্ন হয়। কতকগুলি কার্য্য প্রত্যেক প্রদেশের দরবারই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ প্রণালীতে সম্পন্ন করিয়া থাকে। প্রাদেশিক রাষ্ট্রের দরবারগুলি ঐ সকল বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। আর কতকগুলি কার্য্য আছে যাহার উপর প্রাদেশিক রাষ্ট্রের হাত নাই, সে গুলিকে প্রাদেশিক দরবার নিয়ন্ত্রি করিতে অনধিকারী। এই সব কার্য্য গুলিকে আমেরিকায় ‘জাতীয়’ বা ‘সার্ব্বপ্রাদেশিক’ নামে চিহ্নিত করা আছে। এই সমুদয় কার্য্যনির্ব্বাহের ভার ‘ফেডারেল সরকার’ বা যুক্তদরবারের উপর ন্যস্ত। যুক্তদরবার প্রাদেশিক রাষ্ট্রগুলির মত লইয়া একটা নূতন বিধি-ব্যবস্থা করিয়াছেন। সেই ব্যবস্থাকে “জাতীয়” বিধান বলা হইয়া থাকে।

 আমি বলিতে চাহি নিগ্রোসমস্যা আমেরিকার অন্যতম “জাতীয়” সমস্যা—প্রাদেশিক সমস্যা মাত্র নহে। প্রাদেশিক রাষ্ট্রের হাতে নিগ্রোজাতির ভাগ্য রাখিয়া দেওয়া উচিত নয়। নিগ্রোজাতি এত দিন যে পরিশ্রম করিয়াছে তাহার ফলে সমগ্র শ্বেতাঙ্গজাতিই লাভবান্ হইয়াছেন—আমেরিকার সকল প্রদেশেই তাহার সুফল ফলিয়াছে। সুতরাং নিগ্রোজাতিকে মানুষ করিবার জন্য প্রাদেশিক দরবারগুলিকে উপদেশ দিয়াই যুক্তদরবারের নিশ্চিন্ত থাকা উচিত হয় নাই। প্রদেশিক দরবারগুলি আমাদের জন্য যাহা করিতেছেন করুন। কিন্তু আমেরিকার ‘জাতীয় বিধান’ হইতেও আমরা ন্যায়তঃ ও ধর্ম্মতঃ অনেক আশা করিতে পারি।

 যুক্তদরবার আমাদিগের স্থাবর সম্পত্তি লাভ সম্বন্ধে সাহায্য করিতে পারিতেন। যুক্তদরবার আমাদের শিক্ষার জন্য “জাতীয়” কোষাগার হইতে বার্ষিক কিছু প্রদানের ব্যবস্থা করিতে পারিতেন। যুক্তদরবার আমাদিগকে রাষ্ট্রীয় অধিকারভোগের জন্য যথাবিধি উপযুক্ত করিয়া লইবার চেষ্টা করিতে পারিতেন। যুক্তদরবার সাদা কাল চামড়ার প্রভেদ ধীরে ধীরে তুলিয়া দিবার জন্য অবস্থানুসারে ব্যবস্থা করিতে পারিতেন। আমাদিগকে স্বাধীনতা দিবার পরক্ষণ হইতেই এই সকল সমস্যা যুক্তরাষ্ট্রে উঠিবে তাহা ফেডারেল সরকারের জানা উচিত ছিল। তাহা জানিয়া প্রথম হইতেই আমাদিগের ভবিষ্যতের জন্য কিছু কিছু কর্ম্ম করাও উচিত ছিল। কিন্তু যুক্তদরবার বেশী কিছু করিলেন না।

 আমার স্বজাতিরা অবশ্য আশা করিতে ছাড়িল না। আমরা প্রাদেশিক রাষ্ট্রের নিকট যাহাই পাই না কেন, যুক্ত-দরবারের নিকটও আমরা সকল বিষয়েই সুবিচার এবং ন্যায়সঙ্গত অনুশাসন আশা করিতে লাগিলাম। আমার বয়স তখন বেশী নয়—প্রায় ২০।২১ বৎসর হইয়াছে। তখনই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে যে নূতন “জাতীয় বিধান” প্রস্তুত করা হইতেছে তাহাতে নিগ্রোজাতি সম্বন্ধে ন্যায্য বিচার করা হয় নাই। নিগ্রোসমস্যা কর্ত্তৃপক্ষেরা যথাযথ বুঝিতে পারেন নাই অথবা পারিয়াও তাহার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করেন নাই।

 সহজে দুইটি জিনিষ লক্ষ্য করিতে পারিয়াছিলাম। প্রথমতঃ আমরা অশিক্ষিত এই আপত্তি তুলিয়া তাঁহারা সকল কাজকর্ম্মে আমাদিগকে ছাড়িয়া শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিগণকে নিযুক্ত করিতেন। দ্বিতীয়তঃ উত্তরপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গেরা দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গদিগকে অপমান ও যন্ত্রণা দিবার জন্য তাহাঁদের উপর ‘কাল আদমী’ চাপাইতে চেষ্টা করিত। আমি দেখিলাম দুই দিকেই অন্যায় হইতেছে। আমি বুঝিলাম এ ব্যবস্থা বেশী দিন টিকিবে না। শীঘ্রই উহার পরিবর্ত্তন অবশ্যম্ভাবী।

 জোর করিয়া আমাদিগকে দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গমহলে কর্ত্তামি করিতে দিলে আমাদের বর্ত্তমান অহঙ্কার বাড়িতে পারে কিন্তু ভবিষ্যতের পক্ষে আমাদের সমূহ ক্ষতি। কারণ এই লোভে পড়িয়া আমরা আমাদের যথার্থ উন্নতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হইতে দূরে সরিয়া পড়িতে পারি আশঙ্কা আছে।

 কৃষি শিল্প ও ব্যবসায়ে লাভবান্ হইয়া সম্পত্তির মালিক না হইলে কখনও কি প্রকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করা যায়? না রাষ্ট্রজীবনে প্রভাব বিস্তার করা যায়? টাকা পয়সা গৃহ-সম্পত্তি ইত্যাদির অধিকারী হইবার জন্য চেষ্টা করাই তখন আমাদের সর্ব্বপ্রধান কর্ত্তব্য ছিল। অধিকন্তু লেখা পড়া না শিখিলেই বা রাষ্ট্রীয় জীবনের কর্ত্তব্য পালন করিব কি করিয়া? রাষ্ট্রজীবনের জন্য দায়িত্ববোধ পুষ্ট করিবার পক্ষে বিদ্যালাভই প্রধান সহায়। সুতরাং শিক্ষালাভ ও সম্পত্তিলাভ এই দুই দিকে মন না দিয়া আমরা যদি হুজুগে পড়িয়া দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গসমাজে বড় বড় চাকরী করিতে থাকিতাম, তাহা হইলে আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির মূলে কুঠারাঘাত হইত আমি ইহা বেশ বুঝিতাম। এই জন্যই উত্তর অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গদিগের মেজাজ দেখিয়া আমি একেবারেই খুসী হই নাই। আর আমার মনে বেশ ধারণা জন্মিয়াছিল যে, নিগ্রোজাতিকে যে অস্বাভাবিক ভাবে চালাইবার চেষ্টা হইতেছে তাহা কোনমতেই টিকিতে পারে না।

 তাহার উপর, আমাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতার দোহাই দিয়া যুক্তরাষ্ট্র আমাদিগকে রাষ্ট্রীয় অধিকার হইতে বঞ্চিত করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহাই কি চিরকাল টিকিতে পারে? আমি বুঝিয়াছিলাম তাঁহাদের এই ‘অছিলা’ শীঘ্রই ঘুচিয়া যাইবে। আমরা বেশী দিন অজ্ঞ থাকিব না। আমাদিগকে শিক্ষিত করিয়া লইতে তাঁহারা বাধ্য হইবেন।

 আমি ত আমাদের ভবিষ্যতের স্থায়ী মঙ্গলের কথাই ভাবিতাম। কিন্তু নিগ্রোসমাজের সাধারণজনগণ ত অত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল না। তাহারা শিল্প, শিক্ষা, কৃষি সম্পত্তি ইত্যাদি ভুলিয়া রাষ্ট্রীয় জীবনের দিকেই বেশী ঝুঁকিল। অতি সামান্য মাত্র বিদ্যা লইয়াই নিগ্রোরা রাজনৈতিক আন্দোলনের পাণ্ডা হইতে লাগিলেন। কত নিগ্রোই যে এইরূপে প্রাদেশিক দরবারের মন্ত্রণাসভায় ঢুকিয়াছিল তাহার ইয়ত্তা নাই। আমিও একবার এই হুজুগে পড়িবার মত হইয়াছিলাম। কিন্তু শীঘ্রই আমার ভুল বুঝিতে পারিয়া সামলাইয়া লইয়াছি।

 রাষ্ট্রনৈতিক কর্ম্মক্ষেত্রে সমাজে বেশ সাময়িক নাম করা যায়। কিছুকাল হৈচৈ গণ্ডগোল হুজুগ আন্দোলন লাফালাফি ইত্যাদি সৃষ্টি করিয়া খ্যাতি অর্জ্জন করা যায়। দলপতি, জননায়ক ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত হইয়া গৌরব ও অহঙ্কার করা চলে। কিন্তু দেশের মাটির ভিতর জাতীয় উন্নতির বীজ বপন করিবার জন্য ওরূপ হুজুগে মাতিলে চলে না। স্থিরভাবে, সহিষ্ণুভাবে, দৃঢ়ভাবে লোকচরিত্র ও লোকমত গঠন করা আবশ্যক। জন গণের বিদ্যাবুদ্ধি মার্জ্জিত করা প্রয়োজন—তাহাদিগকে দায়িত্বপূর্ণ কর্ম্মে অভ্যস্ত করা প্রয়োজন—তাহাদিগকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করিবার সুযোগ দিয়া নানা উপায়ে গড়িয়া তোলা প্রয়োজন। তাহার উপর স্বাধীন অন্ন-সংস্থানের ভিত্তি স্বরূপ কৃষিবাণিজ্য ইত্যাদি সমাজের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। এই সকল কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে হইলে নীরবে নিঃশব্দে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকিয়া কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য। কিন্তু এই কঠিন সাধনায় ব্রতী না হইয়া লোকেরা তরলমতি শিশুর ন্যায় রাষ্ট্রনৈতিক হুজুগে যোগ দিতেই বেশী ভালবাসে। আমার নিগ্রোসমাজেও প্রথম প্রথম এইরূপ ঘটিয়াছে।

 আমার স্বজাতিরা দলে দলে রাষ্ট্র-জীবনে প্রবেশ করিতে লাগিল। কেহ কেহ অবশ্য বেশ যোগ্যতার সহিতই দায়িত্বপূর্ণ কর্ম্ম করিতে পারিলেন। মন্ত্রণা সভায়, বিচারালয়ে, শাসনকর্ম্মে নিগ্রোরা অনেকেই যথেষ্ট খ্যাতি অর্জ্জন করিতে লাগিলেন। কিন্তু গলদই বেশী বাহির হইত। অনেক ত্রুটি, অনেক অসম্পূর্ণতা আমাদের নিগ্রো কর্ম্মচারীদিগের মধ্যে দেখা যাইত। আজকাল সে অবস্থার অনেক উন্নতি হইয়াছে। এখন আমরা নিতান্তই অজ্ঞ ও মূর্খের ন্যায় কার্য্য করি না। বিগত ৩০ বৎসরের শিক্ষার ফলে, অভ্যাসের ফলে এবং অভিজ্ঞতার ফলে কৃষ্ণাঙ্গ সমাজ রাষ্ট্রকর্ম্মে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যই অর্জ্জন করিয়াছে একথা বলিতে আমি দ্বিধা বোধ করি না।

 আজ আমি বলিতে পারি যে সাদা ও কাল চামড়ার প্রভেদ এখন পূর্ব্বের ন্যায় রহিত হওয়া কোন মতেই উচিত নয়। যোগ্যতানুসারে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ সমাজের মধ্যে কর্ত্তব্য বিভাগ করা হউক, এবং সম্মান লাভের সুযোগগুলিও বিকিরণ করা হউক। জাতিনির্ব্বিশেষে সকলকে সকল কর্ম্মের অধিকার প্রদান করা হউক। নিগ্রোকে আর সকল বিষয়ে চাপিয়া রাখিবার প্রয়োজন নাই। প্রত্যেক প্রাদেশিক রাষ্ট্রেই যথার্থ ন্যায়সঙ্গত আইন প্রস্তুত করা বাঞ্ছনীয়। যদি শীঘ্র শীঘ্রই নূতন যুক্তিসঙ্গত বিধান প্রস্তুত করা না হয় নিগ্রোদিগকে বিরক্ত করিয়া তোলা হইবে। আমি বলিতেছি—নিগ্রোরা আর সহ্য করিবে না শ্বেতাঙ্গ সমাজেরও অমঙ্গল হইবে—যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার পূর্ণ হইয়া উঠিবে। ৩০ বৎসর পূর্ব্বে দাসত্ব প্রথা যেমন আমেরিকার প্রধান পাপ ছিল, আজ অবিচার অন্যায় আইন, সাদাকাল চামড়াভেদে রাষ্ট্রীয় অধিকার-বিতরণ ইত্যাদিও আমেরিকার রাষ্ট্রজীবনের ঠিক সেইরূপ গর্হিত ও পাপপূর্ণ লক্ষণ। পক্ষপাতশূন্য অনুশাসন প্রবর্ত্তন পূর্ব্বক এই পাপ দূর করিবার জন্য সকলেরই চেষ্টা করা কর্ত্তব্য।

 ১৮৭৮ সাল পর্য্যন্ত আমি ম্যাল্‌ডেনে শিক্ষকতার কর্ম্ম করিলাম। এই দুই বৎসরে আমি আমার দুই ভাইকে এবং আরও কয়েকজন বালক ও বালিকাকে অনেকটা তৈয়ারী করিয়া লইলাম। ইহারা ইতিমধ্যে হ্যাম্পটনে উচ্চ শিক্ষালাভের উপযুক্ত হইয়া উঠিল। তাহার পর আমি নিজে কলম্বিয়া প্রদেশের ওয়াশিংটন নগরে আট মাস লেখা পড়া শিখিতে যাই। এই বিদ্যালয়ে শিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না—সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়েই গ্রন্থ পাঠ এখানে বেশী হইত। কিন্তু হ্যাম্পটনে কৃষি, পশুপালন, শিল্প ইত্যাদির দিকেই বেশী দৃষ্টি থাকিত।

 আমি ওয়াশিংটনে থাকিতে থাকিতে এই দুই প্রকার শিক্ষালয়ের প্রভেদ বুঝিতে পারিলাম। ওয়াশিংটনের ছাত্রদের বেশ দুপয়সা আছে। তাহারা কিছু ‘বাবু’—তাহাদের পোষাক পরিচ্ছদ উচ্চ ধরণের—বিলাসের মাত্রাও যথেষ্ট। বোধ হয় ইহারা লেখাপড়া হিসাবেও মন্দ নয়। নিতান্ত গণ্ডমূর্খ আসিয়া ওয়াশিংটনে ঢুকিতে পায় না। কিন্তু হ্যাম্পটনের আবহাওয়া সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ওখানকার চালচলন ভিন্ন রকমের। দাতারা ছাত্রদের বেতন দান করিতেন—সুতরাং উহা অবৈতনিক বিদ্যালয়। কিন্তু কাপড় চোপড়, কাগজ পত্র, পুস্তক সরঞ্জাম ইত্যাদি এবং খাওয়া পরার খরচ ছাত্রদিগকেই দিতে হইত। এই টাকা ছাত্রেরা খাটিয়া সংগ্রহ করিত। কেহ কেহ বাড়ী হইতেও কিছু আনিত।

 ওয়াশিংটনের ছাত্রেরা একেবারেই স্বাবলম্বী নহে—তাহাদের খরচপত্র সম্বন্ধে তাহারা নিশ্চিন্তভাবে দিন কাটাইত। কিন্তু হ্যাম্পটনে স্বাবলম্বন এবং নিজের খরচ নিজে চালানই ছাত্রদিগের বিশেষ লক্ষণ। ওয়াশিংটনের ছেলেরা বাহিরের ‘চটকে’ বেশ দৃষ্টি রাখিত। জীবনের প্রকৃত ভিত্তি আত্মসম্মান, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস ইত্যাদির প্রতি তাহাদের বিশেষ নজর ছিল না। জীবনের লক্ষ্য, মানবের কর্ত্তব্য, ভবিষ্যতের আদর্শ ইত্যাদি সম্বন্ধেও তাহারা বেশীকিছু শিখিত বলিয়া মনে হয় না। তাহারা গ্রীকল্যাটিন ইত্যাদি কত বিষয়ই শিখিত। কিন্তু প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা প্রণালী সম্বন্ধে তাহাদের অজ্ঞতা দেখিয়া হাস্য সংবরণ করা কঠিন। লেখাপড়া শিখিয়া তাহারা যে সমাজে বাস করিবে তাহার উপযুক্ত কাজকর্ম্ম, চালচলন তাহারা আদৌ শিখিত না। বরং অনেক বিষয়ে তাহাদের ক্ষতিই হইত। কয়েক বৎসর বেশ ভাল বাড়ীতে বাস, ভাল খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি করিয়া তাহারা অনেকটা অকর্ম্মণ্য, অসহিষ্ণু হইয়া পড়িত। পল্লীতে আসিয়া বাস করা তাহাদের পক্ষে অসম্ভব বোধ হইত। শারীরিক পরিশ্রমে নারাজ হইত। গৃহস্থালীর কর্ত্তব্য, চাষবাস, পশুপালন ইত্যাদি তাহারা একেবারেই ভুলিয়া যাইত। আফিসের কেরাণী, পরিবারের ম্যানেজার, হোটেলের বাবুরচি, অথবা খান্সামা, দ্বারবান্ ইত্যাদি হইয়া জীবন কাটাইতে তাহারা ভালবাসিত। কিন্তু মাঠে যাইয়া কষ্ট-স্বীকার পূর্ব্বক জমি চষিতে তাহারা অসমর্থ হইয়া পড়িত।

 আমি যে কয় মাস ওয়াশিংটনে ছিলাম তখন ওখানে অনেক নিগ্রো বাস করিত। সকলেই পল্লী ত্যাগ করিয়া সহরে আসিয়াছে। গ্রামের কষ্ট তাহাদের সহ্য হয় না। সহরের বিলাস ছাড়িয়া তাহারা অন্যত্র বাস করিতে অসমর্থ। কেহ কেহ প্রাদেশিক রাষ্ট্রের নিম্নপদস্থ কর্ম্মচারী, কেহ বা যুক্তদরবারের বড় চাকরী পাইবার আশায় কাল কাটাইতেছে। কেহ কেহ মন্ত্রণা সভার এবং ব্যবস্থাপক সমিতিতে সদস্যগিরিও করিত। ফলতঃ কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের একটা বড় টোলা কলম্বিয়া প্রদেশের এই নগরে প্রতিষ্ঠিত হইয়া গেল। নিগ্রোদিগের জন্য তখন সেখানে কতকগুলি বিদ্যালয়ও খোলা হইতেছিল। সকল বিষয়ে আমি এই নগরটা পর্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। আমাদে সমাজের গতিবিধি ও নৈতিক অবস্থা বুঝিতে চেষ্টা করিলাম।

 বড় সহরের সুফল কুফল সবই আমার স্বজাতিকে আক্রমণ করিয়াছিল। কতকগুলি নিষ্কর্ম্মা লোকের আড্ডা অনেক স্থানেই দেখিতে পাইতাম। বিলাসের স্রোত প্রবল বেগেই বাড়িতেছিল। ৩৫৲ টাকা মাসিক বেতনে কর্ম্ম করিয়া কত নিগ্রো যুবক জুড়িগাড়ী চড়িয়া হাওয়া খাইতে বাহির হইতেন—আমি নিজ চোখে এসব দেখিয়া মর্ম্মাহত হইতাম। পেটে তাহাদের অন্ন জুটিত না কিন্তু সংসারকে তাহারা দেখাইতে চাহিত যে তাহারা নিতান্তই গরিব ও নগণ্য নয়। আরও কত নিগ্রোকে দেখিয়াছি যাহারা ২৫০।৩০০৲ মাসিক বেতনে সরকারের চাকরী করিত—অথচ প্রতি মাসেই তাহাকে ধার করিয়া সংসার চালাইতে হইত। অত টাকা পাইয়াও তাহারা স্বপরিবারের খরচ কুলাইয়া উঠিতে পারিত না! আরও অনেক নিগ্রোর সঙ্গে আলাপ হইয়াছিল। তাঁহারা কয়েক মাস পূর্ব্বে ‘জাতীয়’ মহাসমিতি কংগ্রেসে যাইয়া কর্ত্তামী ও দেশ-নায়কতা করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁহাদের অর্থাভাব ও দুর্দ্দশার সীমা নাই। অধিকন্তু বহুলোক ফ্যাল্ ফ্যাল্ করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত। নিজে খাটিয়া অন্নের ব্যবস্থা করিতে তাহাদের চেষ্টা ছিল না। সরকারের একটা চাক্‌রীর আশায় বসিয়া থাকিয়া জীবন নিরানন্দময় করিতে থাকিত। তাহাদের বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের কর্ম্মচারীদের খোসামোদ করিলে দুএকটা চাকরী তাহাদের কপালে জুটিবে।

 বড় সহরের নিগ্রোসমাজ দেখিয়া আমি সুখী হইতে পারি নাই। তাহারা নিজেদের প্রকৃত স্বার্থ ভুলিয়া সাময়িক উত্তেজনায় এবং অনর্থক বিলাসভোগে দিন অতিবাহিত করিতেছিল। আমার ইচ্ছা হইত যে, কোন যাদুমন্ত্রে তাহাদের ঐ মোহ কাটাইয়া দিই। আমার সাধ হইত যে, তাহাদিগকে সম্মোহনমন্ত্রে ভুলাইয়া জীবনের যথার্থ কর্ম্মক্ষেত্রে তাহাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিই। আমি ভাবিতাম যে, আমার ক্ষমতা থাকিলে, আমি তাহাদিগকে সহর ছাড়াইয়া পল্লীগ্রামে বসাইতাম। সেখানে প্রকৃতি জননীর সুকোমল ক্রোড়ে বাস করিয়া তাহারা জীবনের যথার্থ উন্নতি সাধন করিতে পারিবে। দেশের মাটিতে তাহারা একবার বসিতে পারিলে প্রকৃত সুখভোগের উপায়গুলি তাহারা আবিষ্কার করিতে পারিবে। কৃষিক্ষেত্রেই শিল্পির জন্য কাঁচা মাল তৈয়ারী হইয়া থাকে—পল্লীজীবনেই সকল জাতির যথার্থ সভ্যতার, প্রধান উপাদান উৎপন্ন হইয়া থাকে। পল্লীগ্রামে কৃষিকর্ম্ম করিয়াই সকল দেশের জনসমাজ সভ্যতার প্রথম স্তরে পদার্পণ করিয়াছে। এই স্তরে ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে তাহারা শিল্প, বাণিজ্য, বিদ্যা, ধর্ম্ম, ইত্যাদি জাতীয় জীবনের সকল অঙ্গের পুষ্টিবিধান করিতে সমর্থ হইয়াছে। প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করা বড় কষ্ট-কল্পনাসাধ্য সন্দেহ নাই। কিন্তু একবার ঐ কার্য্য হইয়া গেলে ভবিষ্যতের সকল উন্নতিই সহজসাধ্য হইয়া পড়ে। এই কথাগুলি আমি আমার ‘সহুরে’ নিগ্রোদিগকে বুঝাইতে ইচ্ছা করিতাম। কিন্তু তখন আমার সুযোগ ছিল না। ভবিষ্যতে এই সকল কথা আমি নানা ভাবে নানা স্থানে প্রচার করিয়া আসিয়াছি।

 ওয়াশিংটনের নিগ্রোরমণীদিগের অবস্থা কিছু বলিতেছি। অনেকে ধোপার কার্য্য করিয়া অন্ন সংস্থান করিত। পারিবারিক ভাবে এই ব্যবসায়গুলি চলিত। মায়ে ঝিয়ে সকলে মিলিয়া কাপড় চোপড় পরিষ্কার করিত। এইরূপে সমস্ত পরিবারই কর্ম্ম করিয়া যৌথভাবে অর্থ উপার্জ্জন করিত। ইহার ফলে মেয়েরা অল্প বয়স হইতেই দেখিয়া দেখিয়া এবং কাজ করিয়া বস্ত্রধৌতি কর্ম্মে পটুত্ব অর্জ্জন করিত। কিন্তু ক্রমশঃ মেয়েরা স্কুলে ভর্ত্তি হইল। ওখানে ৭।৮ বৎসর কাল লেখা পড়া শিখিত। যখন বিদ্যাশিক্ষা শেষ হইয়া যাইত তাহারা ভাল ভাল পোষাক চাহিত। তাহাদের খরচ পত্র বাড়িয়া গেল—অথচ উপার্জ্জন করিবার ক্ষমতা কমিতে থাকিল। কারণ ইতিমধ্যে তাহারা গৃহস্থালী ভুলিয়া গিয়াছে ধোপার কর্ম্ম করিতেও অপারগ হইয়া পড়িয়াছে। পুঁথিবিদ্যার ফলে তাহাদের সর্ব্বনাশ উপস্থিত হইয়াছে। মা মাসীমা যে কাজ করিতে পারিত সে কাজে তাহাদের এখন লজ্জা ও অপমান বোধ হয়। পারিবারিক সুখ আর থাকিল না। মেয়েরা দুশ্চরিত্র হইতে লাগিল। সহুরে বিদ্যাশিক্ষায় আমাদের রমণীসমাজ ক্রমশঃ অবনত হইতে থাকিল।