বিষয়বস্তুতে চলুন

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/চতুর্থ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ অধ্যায়

হ্যাম্পটনে জীবন গঠন

 দেখিতে দেখিতে হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ে আমার এক বৎসর কাটিয়া গেল। গরমের ছুটি আসিল। সকলেই নিজ নিজ বাড়ী চলিয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু আমি বাড়ী যাই কি করিয়া? হাতে একটি পয়সাও নাই। অথচ তখনকার দিনে ছুটির সময়ে স্কুলে থাকিবারও সুবিধা ছিল না। মহা মুস্কিলে পড়িলাম। ওখান হইতে পড়িতে হইলেও ত কিছু খরচ আবশ্যক।

 আমি ইতিমধ্যে একটা পুরাতন জামা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। ভাবিলাম ঐটা বেচিয়া যদি কিছু পাওয়া যায়। আমি অবশ্য কোন লোককে জানিতে দিলাম না যে হাতে পয়সা নাই বলিয়া আমি বাড়ী যাইতে পারিতেছি না। ছেলেবেলায় ওরূপ অহঙ্কার ও লজ্জা সকলেরই থাকে। আমার কোট বেচিবার কারণ এক একজনকে এক একরূপ বুঝাইলাম। একটি নিগ্রো বালক আমার ঘরে জামাটা দেখিতে আসিল। সে ইহার এপীঠ ওপীঠ খুব ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল এবং দাম জানিতে চাহিল! আমি বলিলাম, “৯৲ টাকার কমে কি ছাড়া যায়?” সেও বোধ হয় বুঝিল—দাম ঐরূপই হইবে। কিন্তু তাহারও অর্থাভাব। কালবিলম্ব না করিয়া সে অতি নির্লজ্জভাবে বলিয়া ফেলিল—“দেখ বাপু, কাজের কথা বলি, শুন। জামাটা ত আমি এখনই লইতেছি, এবং নগদ দশ পয়সা দিতেছি। বাকী দামটা যখন সুবিধা হয়, দিব।” বলা বাহুল্য আমি নিতান্তই হতাশ হইয়া পড়িলাম।

 কোন মতে হ্যাম্পটন ছাড়িয়া যাইতে পাইলেই আমি নানাস্থানে কাজ খুঁজিয়া লইতে পারিব বিশ্বাস ছিল। কিন্তু হ্যাম্পটন হইতে বাহির হওয়াই অসম্ভব। এদিকে ছাত্র, শিক্ষক সকলেই একে একে চলিয়া গেলেন। আমি একাকী রহিলাম। আমার দুঃখের আর সীমা থাকিল না।

 শেষ পর্য্যন্ত একটা হোটেলে চাকরী পাইলাম। কিন্তু বেতন বড় কম। যাহা হউক লেখা পড়ার সময় অনেক পাইতাম। ফলতঃ গরমের ছুটীটায় আমি বেশ খানিকটা শিখিয়া ফেলিলাম।

 গরমের ছুটির সময়ে আমি বিদ্যালয়ের নিকট ৫০৲ ঋণী ছিলাম। ছুটিতে খাটিয়া টাকা পাইলে ঐ ধার শোধ করিব মনে করিয়াছিলাম। ছুটি ফুরাইয়া আসিল কিন্তু ৫০৲ কোন মতেই জমা হইল না।

 একদিন হোটেলের একটা কামরায় টেবিলের নীচে ৩০৲ টাকার একখানা ‘নোট’ কুড়াইয়া পাইলাম। আমি হোটেলের কর্ত্তার নিকট উহা লইয়া গেলাম। ভাবিয়াছিলাম কিছু অন্ততঃ পাওয়া যাইবে। কিন্তু তিনি বলিলেন “ওখানে আমিই বসিয়া কাজ করি—সুতরাং উহা আমারই প্রাপ্য।” এই বলিয়া তিনি ৩০৲ টাকার নোট পকেটস্থ করিলেন। আমি কিছু পাইলাম না।

 এত কষ্টে পড়িলে হতাশ হইবারই কথা। কিন্তু উহা কাহাকে বলে আমি তাহা জানিই না। জীবনের কোন অবস্থাতেই আমি এখন পর্য্যন্ত নৈরাশ্য আস্বাদ করি নাই। যখনই যে কাজ ধরিয়াছি, আমার বিশ্বাস থাকিত যে আমি তাহাতে কৃতকার্য্য হইবই। সুতরাং যাঁহারা বিফলতার আলোচনা করেন, তাঁহাদের সঙ্গে আমার কোন দিনই মতে মিলে না। কৃতকার্য্য কি উপায়ে হওয়া যায় একথা যিনি বুঝাইতে পারেন আমি তাঁহারই ভক্ত। বিফলতা কেন হয়—একথা যিনি বুঝাইতে আসেন আমি তাঁহার কাছে ঘেঁসি না।

 ছুটির শেষে বিদ্যালয়ে গেলাম। কর্ত্তৃপক্ষকে বলিলাম—“ধার শোধ করিবার ক্ষমতা এখনও আমার হয় নাই—স্কুলে প্রবেশ করিতে পারি কি?” খাজাঞ্জি ছিলেন সেনাপতি মার্ণ্যাল। তিনি সাহস দিয়া বলিলেন, “তোমাকে এ বৎসর ভর্ত্তি করিয়া লইলাম। তুমি একদিন না একদিন আমাদের ঋণ শোধ করিতে পারিবে—আমার বিশ্বাস আছে।” দ্বিতীয় বৎসরও পূর্ব্বের ন্যায় আমি খান্‌সামাগিরি করিতে করিতে এখানে লেখাপড়া শিখিতে থাকিলাম।

 হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ে বই পড়ানও হইত বটে, কিন্তু পুস্তক পাঠ অপেক্ষা অন্যান্য অসংখ্য উপায়েই আমি ওখানে বেশী শিক্ষা লাভ করিয়াছি। দ্বিতীয় বৎসরে আমি শিক্ষকগণের স্বার্থত্যাগ ও চরিত্রবত্তা দেখিয়া বিশেষ উপকৃত হইয়াছিলাম। তাঁহারা নিজের কথা না ভাবিয়া কেবল মাত্র পরের কথাই ভাবিতেন। তাঁহাদের জাতিমর্য্যাদা ছিল, বংশগৌরব ছিল, বিদ্যার সম্মান ছিল; সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তিও ছিল। তাঁহারা ইচ্ছা করিলে নিজের আর্থিক উন্নতি যথেষ্ট করিতে পারিতেন—সংসারে নূতন নূতন যশোলাভের সুযোগও তাঁহাদের কম ছিল না। কিন্তু তাঁহারা সে সকল দিকে দৃষ্টিপাত করিতেন না—আমাদের অবনত কৃষ্ণকায় সমাজকে বিদ্যায়, ধনে ও ধর্ম্মে উন্নত করিবার জন্য জীবন সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই কর্ম্মেই তাঁহাদের একমাত্র সুখ ছিল। দ্বিতীয় বৎসরের বসবাসের ফলে আমি শিখিলাম যে পরোপকারী ব্যক্তিই একমাত্র সুখী। যাঁহারা অন্য লোককে নানা উপায়ে সুখী ও কর্ম্মঠ করিয়া তুলিতেছেন তাঁহাদের অপেক্ষা সুখী লোক সংসারে আর নাই। এই শিক্ষা আমার জীবনে কখনও নষ্ট হইবে না।

 হ্যাম্পটনে আমি পশুপক্ষী জীবজন্তু ইত্যাদি সম্বন্ধে খুব ভাল রকম জ্ঞান লাভ করি। এখানকার কৃষিবিভাগের জন্য অতি উত্তম জাতির পশুপক্ষী আমদানি করা হইত। ঐ গুলিকে পালন করিবার ব্যবস্থাও অতি উন্নত ধরণের ছিল। এই সকল কাজে আমরা অভ্যস্ত হইতাম—তাহাতে কৃষিকর্ম্ম, পশুপালন, জীব বিদ্যা, প্রাণি-তত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কার্য্যকরী শিক্ষা হইয়া গিয়াছিল। তাহার ফলে আজ পর্য্যন্ত আমি জীবজন্তুর ভাল মন্দ বাছিয়া লইতে সমর্থ। ছেলে বেলা হইতে ভাল ভাল জানোয়ার এবং তাহাদের গতিবিধি অভ্যাস স্বভাব, খাদ্যাখাদ্য, রোগ ঔষধ ইত্যাদি দেখিবার সুযোগ পাইলে প্রত্যেক লোকই ভবিষ্যতে পাকা ওস্তাদ হইয়া উঠিতে পারে।

 দ্বিতীয় বৎসরের সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান শিক্ষা হইয়াছিল—বাইবেল গ্রন্থের উপকারিতা। কেবল ধর্ম্মগ্রন্থ হিসাবেই নহে, উৎকৃষ্ট সাহিত্য হিসাবেও বাইবেল বিশেষরূপেই পাঠ করা উচিত—এই ধারণা জন্মিয়াছিল। ফলতঃ, আজকাল কাজের খুব ভিড় থাকিলেও আমি দুই এক অধ্যায় বাইবেল না পড়িয়া দিন যাইতে দিই না।

 বাইবেলের উপকারিতা আমি কুমারী লর্ডের শিক্ষকতায় বুঝিতে পারিয়াছিলাম। তাঁহার নিকট আমি আর এক কারণেও ঋণী। আজ কাল আমি বক্তৃতা করিতে মন্দ পারি না—এমন কি, সাহিত্যজগতে আমি বাগ্মী বলিয়াই খ্যাত। এই বক্তৃতা করিবার ক্ষমতা আমাকে কুমারী লর্ডই শিখাইয়াছিলেন। শ্বাস প্রশ্বাসের নিয়ম, উচ্চারণ করিবার রীতি, জোর দিবার ভঙ্গী, দম লইবার কায়দা, ইত্যাদি বক্তৃতা করিবার আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি আমি তাঁহার নিকট শিখিয়াছিলাম। এইগুলি শিখিবার জন্য আমি ইহাঁর নিকট বিদ্যালয়ের অবকাশকালে একাকী উপদেশ লইতাম।

 আমি অবশ্য বক্তৃতা ও বাচালতার একেবারেই পক্ষপাতী নহি। কেবল ওজস্বিতা বা বাক্যযুদ্ধ ও কথার মারপ্যাচ দেখাইবার জন্য আমি বক্তৃতা অভ্যাস করি নাই—এবং কখনও বক্তৃতা দিই নাই। ছেলেবেলা হইতে আমি পরোপকার কর্ম্মে ব্রতী হইব স্থির করিয়াছিলাম। জগতের বিদ্যাভাণ্ডার ও কর্ম্ম-কেন্দ্রগুলিকে পুষ্ট করিবার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়াছিল। আমি ভাবিতাম, যদি কোন উপায়ে সংসারের উপকার করিতে পারি তাহা হইলে সে সম্বন্ধে লোকজনকে বুঝানও আবশ্যক হইবে। আমি বুঝিয়াছিলাম,—একটা কোন অনুষ্ঠান আরম্ভ করিয়া তাহা সফল করিতে পারিলে লোকসমাজে তাহার প্রচারের জন্যও ব্যবস্থা করিতে হইবে। এই বুঝিয়া সদনুষ্ঠানের প্রচার, সৎকর্ম্মের বিস্তার এবং সদ্ভাবের প্রসার ইত্যাদি উদ্দেশ্যেই আমি বাগ্মিতার শিক্ষা লইতেছিলাম—ফাঁকা আওয়াজ করিয়া বাহবা লইবার জন্য নহে। আমার মতে “কার্য্য আগে করিব—তাহার পরে তাহা জগৎকে জানাইব”—এই আদর্শেই বাগ্মিগণের জীবন গঠন করা কর্ত্তব্য।

 হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ে অনেকগুলি ডিবেটিং ক্লাব বা আলোচনাসমিতি ছিল। প্রতি শনিবার সন্ধ্যাকালে তাহাদের অধিবেশন হইত। এই অধিবেশনগুলির একটাও কখন বাদ দিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। এদিকে এত ঝোঁক ছিল যে আমি এইগুলির অতিরিক্ত একটা নূতন সমিতিও প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলাম। আমাদের খাওয়া শেষ হইবার পর পড়া আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে প্রায় ২০ মিনিট ফাঁক থাকিত। এই সময়টা ছেলেরা সাধারণতঃ গল্প গুজবে কাটাইত। আমার উদ্যোগে ২০।২৫ জন ছাত্র মিলিয়া এই সময়টায় আলোচনা বক্তৃতা ইত্যাদি করিবার জন্য একটা নূতন ব্যবস্থা করিয়া লইয়াছিল।

 দ্বিতীয় বৎসরের গ্রীষ্মাবকাশ আসিল। এবার আমার আর্থিক অবস্থা মন্দ ছিল না। আমার মাতা ও দাদা কিছু টাকা পাঠাইয়াছিলেন, একজন শিক্ষকও কিছু দান করিয়াছিলেন। আমি ‘স্বদেশে’ চলিলাম। ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়ার ম্যাল্‌ডেনে এবার ছুটি কাটিল

 বাড়ীতে আসিয়াই দেখি, নুনের কল বন্ধ, কয়লার খাদে কাজ চলিতেছে না, কুলীরা সব ‘ধর্ম্মঘট’ করিয়াছে। এই ধর্ম্মঘটের একটা রহস্য বলিতেছি। প্রায়ই দেখিতাম, যখন কুলী মহলের পরিবারে দুই তিন মাসের উপযুক্ত খরচের টাকা জমা হইয়া গিয়াছে তখনই তাহারা কাজ কর্ম্ম ছাড়িয়া মহাজনগণকে বিব্রত করিত। যখনই বসিয়া খাইতে খাইতে টাকা ফুরাইয়া আসিত তখনই আবার তাহারা দলে দলে কাজে ঢুকিত। এইরূপে অনেকে যথেষ্ট দেনাও করিয়া ফেলিত। তখন আর তাহারা তাহাদের পুরাতন অভাব অভিযোগ ইত্যাদির কথা তুলিতই না—কোন উপায়ে একটা কাজ পাইলেই খুসী থাকিত। মোটের উপরে দেখিতাম, যে ধর্ম্মঘটের ফলে কুলীদের সর্ব্বাংশেই ক্ষতি হইত। অনেক সময়ে কল ও খাদের কর্ত্তা তাহাদিগকে পুনরায় কাজ দিতে অস্বীকার করিতেন। তখন তাহারা যথেষ্ট ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার করিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইতে বাধ্য হইত। আমার যতদূর বিশ্বাস, কতকগুলি হুজুগপ্রিয় পাণ্ডাদিগের পাল্লায় পড়িয়া কুলীরা নিজের সর্ব্বনাশ নিজে ডাকিয়া আনিত। ধর্ম্মঘটের আমি আর কোন ব্যাখ্যা ত পাই না।

 আমাকে দেখিয়া আমার পরিবারের সকলেই অবশ্য মহা খুসী। তাহার পর আমার নিমন্ত্রণের পালা পড়িল। পাড়ার প্রত্যেকেই আমাকে তাহাদের বাড়ীতে এক এক দিন খাইতে বলিত। আমি তাহাদিগকে হ্যাম্পটনের গল্প করিতাম। তাহা ছাড়া আমাকে ধর্ম্মমন্দিরে রবিবারের বিদ্যালয়ে এবং আরও কয়েক স্থানে বক্তৃতা করিতেও হইয়াছিল। দিন মন্দ কাটিতেছিল না—কিন্তু ধর্ম্মঘটের ফলে আমার স্বগ্রামে কাজ জুটিল না। তাহা হইলে পুনরায় হ্যাম্পটনে যাইব কি করিয়া? একদিন অনেক দূর পর্য্যন্ত চলিয়া গেলাম তথাপি কাজ পাইলাম না। ফিরিতে বেশী রাত্রি হইয়া পড়ে—রাস্তায় একটা ভাঙ্গা বাড়ীতে শুইয়া থাকিলাম। শেষে দেখি ভোর রাত্রি তিনটার সময় আমার দাদা আমাকে খুঁজিতে খুঁজিতে ঐ ‘পোড়ো’ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত। আমাকে খবর দিলেন যে, রাত্রে মাতার মৃত্যু হইয়াছে।

 মাতার মৃত্যুতে আমি যার পর নাই দুঃখিত হইলাম। তিনি বহু কাল হইতেই ভুগিতেছিলেন জানিতাম—কিন্তু হঠাৎ তাঁহার মৃত্যু হইবে ভাবিতে পারি নাই। আমার সাধ ছিল—অন্তিমকালে আমি তাঁহার সেবা করিব। কিন্তু সে সৌভাগ্যে আমি বঞ্চিত হইলাম। তাঁহার উৎসাহে ও সাহসেই আমি লেখাপড়া শিখিতে পারিয়াছি। তাঁহার অভাব আমার জীবনে একমাত্র দুঃখের কারণ হইল। ইহার পূর্ব্বে আমি কখনও যথার্থ দুঃখ অনুভব করি নাই। তাহার পরেও আমি কখন অন্যান্য দুঃখকে দুঃখ জ্ঞান করি নাই।

 মাতার মৃত্যুর পর আমাদের গৃহস্থালী বিশৃঙ্খলতা পূর্ণ হইয়া গেল। ভগ্নীটি ছোট—সে সকল দিক দেখিয়া উঠিতে পারিত না। আমাদের কোন দিন খাওয়া জুটিত কোন দিন জুটিত না। তাহার উপর আবার আমার চাকরী নাই। এই দুঃখের দিনে রাফ্‌নার পত্নী আমাকে একটা কাজ দিলেন। তাহাতে কিছু পয়সা হইল। তাহার দ্বারা হ্যাম্পটনের পথ খরচের ব্যবস্থা হইয়া গেল। ইতিমধ্যে আমার দাদা একআধটা জামা সংগ্রহ করিয়া আনিলেন।

 স্কুল খুলিতে আরও তিন সপ্তাহ বাকী। এমন সময়ে প্রধান শিক্ষয়িত্রী, কুমারী ম্যাকি আমাকে পত্র দ্বারা জানাইলেন যে, আমাকে সপ্তাহ মধ্যেই ফিরিতে হইবে, এবং ফিরিয়া বাড়ীঘর পরিষ্কার করিয়া রাখিতে হইরে। এই পত্র পাইয়া আমি যার পর নাই সন্তুষ্ট হইলাম। কারণ ইহাতে যে বেতন পাওয়া যাইবে তাহার দ্বারা স্কুলের খরচ অগ্রিম কিছু দেওয়া হইয়া থাকিবে। আমি দেরী না করিয়া হ্যাম্পটনে রওনা হইলাম।

 পৌঁছিয়াই দেখি ইয়াঙ্কি রমণী নিজেই দরজা জানালা বেঞ্চ টেবিল ইত্যাদি পরিষ্কার করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাঁহার কাজ কর্ম্ম দেখিয়া আমি দুইটি শিক্ষা লাভ করিলাম। প্রথমতঃ অতি সম্ভ্রান্ত বংশীয়া এবং উচ্চ শিক্ষিতা রমণীরাও দাসদাসীর ন্যায় শারীরিক পরিশ্রম করিতে কুণ্ঠিত নহেন। দ্বিতীয়তঃ, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ত্তা হওয়া মুখের কথা নয়। তাহার জন্য দায়িত্ব যথেষ্ট। কুমারী ম্যাকির দায়িত্ব জ্ঞান খুব বেশী ছিল। তিনি জানিতেন যে, ছুটির পর স্কুল খুলিবার সময়ে কোন বিষয়ে শৃঙ্খলা না থাকিলে তিনিই নিন্দিত হইবেন। সুতরাং তিনি সমস্ত ছুটিটা নিশ্চিন্তভাবে ভোগ করিতে পারেন না। অন্যান্য সকলে আসিয়া পৌঁছিবার পূর্ব্বে সকল ব্যবস্থা তাঁহাকেই করিয়া রাখিতে হইবে। কর্ত্তার ঝুঁকি তিনি বেশ ভালরকম বুঝিয়াছিলেন।

 তখন হইতে আমি নেতার কর্ত্তব্য এবং নেতৃত্বের যোগ্যতা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি। দায়িত্ববোধহীন পরিচালককে আমি কোন সম্মান করি না। তাহা ছাড়া, যে বিদ্যালয়ে ছাত্রদিগকে শারীরিক পরিশ্রম শিক্ষা দেওয়া হয় না আমি তাহার প্রশংসা করিতে পারি না। ধনবান্ নির্ধন, উচ্চ, নীচ—সকলেরই হাতে পায়ে খাটিয়া কাজ করিতে শিক্ষা করা কর্ত্তব্য। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শারীরিক পরিশ্রম অভ্যাস করাইবার ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। ম্যাকির দৃষ্টান্তে আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হইয়াছিল।

 হ্যাম্পটনে এবার আমার শেষ বৎসর। খুব বেশী খাটিয়া লেখা পড়া করিতে হইল। আমি ‘অনার’-পাশ করিলাম। এই পাশ বেশী গৌরবসূচক বিবেচিত হইত। ১৮৭৫ সালের জুন মাসে—অর্থাৎ প্রায় ১৬/১৭ বৎসর বয়সে আমি হ্যাম্পটন-বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করিলাম। আমার এই তিন বৎসরের শিক্ষার ফল নিম্নে বিবৃত করিতেছি:—

 (১) প্রথমতঃ, আমি একজন প্রকৃত মানুষের মত মানুষের দর্শন পাইয়া তাঁহার প্রভাবে জীবন গঠন করিতে শিথিয়াছি। তাঁহার নাম সেনাপতি আর্মষ্ট্রঙ্গ। আমি পুনরায় বলিতেছি তিনি আমার চিন্তারাজ্যের 'একমেবাদ্বিতীয়ম্‌' মহাবীর। তাঁহার ন্যায় সাধুপুরুষ আর আমি দেখি নাই।

 (২) দ্বিতীয়তঃ, আমি বিদ্যালাভের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নূতন ধারণা অর্জ্জন করিলাম। লোকে লেখাপড়া শিখে কেন? পূর্ব্বে নিগ্রোসমাজের সাধারণ লোকজনের কথাবার্ত্তা ও চালচলন দেখিয়া ধারণা জন্মিয়াছিল যে, শারীরিক পরিশ্রম হইতে মুক্তি পাইবার জন্য বিদ্যা শিক্ষা করিতে হয়। এবং লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ বেশ সুখে স্বচ্ছন্দে বাবুগিরি করিয়া কাল কাটাইতে পারে। হ্যাম্পটনে আমার দিব্যজ্ঞান লাভ হইল। ওখানকার আব্‌হাওয়াতে হাতে পায়ে কাজ করা, খাটিয়া খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা ইত্যাদি কার্য্য প্রত্যেক শিক্ষিত লোকের স্বাভাবিক ধর্ম্মের মধ্যেই পরিগণিত হইত। নিষ্কর্মা মানুষ কাহাকে বলে সেই বিদ্যালয়ের চতুঃসীমার মধ্যে জানিতে পারিতাম না। ছাত্র, শিক্ষক সকলেই পরিশ্রম করিতে ভাল বাসিতেন এবং পরিশ্রমী-লোককে সম্মান করিতেন। পরিশ্রম না করাটাই সেখানে একটা নিন্দনীয় ও গর্হিত কার্য্য ছিল এবং অশিক্ষিত লোকের লক্ষণ বিবেচিত হইত। কাজকর্ম্ম করিলে পয়সা পাওয়া যায়, অন্নের ব্যবস্থা হয়, আর্থিক দৈন্য ঘুচে, সংসার পালন নিরুদ্বেগে করা যায়। এ সকল কথা আমাদের ওখানে সকলেই বুঝিত। এই বুঝিয়া আমরা খাটিতাম–সন্দেহ নাই। কেবল তাহাই নহে, আমরা স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভর হইবার জন্যই এখানে নিজে খাটিতে শিখিতাম। কোন বিষয়ে পরের অধীন থাকিব না, নিজের সকল অভাব নিজেই মোচন করিয়া লইব—এই আদর্শেই আমরা শারীরিক পরিশ্রমকে আদর করিতে শিখিয়াছিলাম। ফলতঃ খাটিয়া খাওয়া এবং শিক্ষালাভে কোন বিরোধ নাই—এই জ্ঞান আমার হৃদয়ে বদ্ধমূল হইয়া গেল।

 (৩) তৃতীয়তঃ স্বার্থত্যাগ ও পরোপকারের শিক্ষা আমি হ্যাম্পটনেই প্রথম পাই। ওখানেই শিখি, যাঁহারা নিজ উন্নতির আকাঙ্ক্ষা খর্ব্ব করিয়া অপরের উন্নতির পথ পরিষ্কার করিবার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন সংসারে একমাত্র তাঁহারাই সুখী। পরোপকার ও লোকসেবা করিতে পারাই মানব জীবনের একমাত্র সুখ।

 আমি হ্যাম্পটনের গ্রাজুয়েট হইলাম সার্টিফিকেটও পাইলাম। ইতিমধ্যে পয়সা ফুরাইয়া আসিয়াছে। একটা হোটেলে চাকরী সংগ্রহ করিলাম। কলেষ্টিকাট প্রদেশের একজনের নিকট কিছু ধার করিয়া পথ খরচের ব্যবস্থা করা গেল। যথা সময়ে সেই চাকরী স্থলে উপস্থিত হইলাম।

 আমার বিদ্যা বুদ্ধি দেখিয়া হোটেলের কর্ত্তা আমাকে পরিবেষণের ভার দিয়াছিলেন, কিন্তু ও বিষয়ে আমার কিছুমাত্র জ্ঞান ছিল না। কয়েকজন বড়লোক টেবিলে খাইতে বসিয়াছেন। আমি পরিবেষণের নিয়ম জানি না দেখিয়া তাঁহারা আমাকে মারিতে উঠিলেন। আমি ভয়ে কাজ ছাড়িয়া দিলাম। তাঁহারা খাদ্যদ্রব্য আর পাইলেন না। এই ঘটনার পর আমাকে নিম্ন শ্রেণীর খান্সামার কাজ করিতে হইল। পরে পরিবেষণের কাজ শিখিয়া লইলাম। আবার সেই উচ্চ পদে উন্নীত হইয়াছিলাম।

 যে হোটেলে আমি এই সময়ে খান্সামাগিরি করিতেছিলাম, এই হোটেলেই আমি ভবিষ্যতে পয়সা খরচ করিয়া অতিথিভাবে বাস করিয়া গিয়াছি। সংসারে এইরূপ পরিবর্ত্তন অহরহ ঘটিতেছে।

 হোটেলের কাজ ছাড়িয়া আমার স্বদেশ ম্যাল্‌ডেন-নগরে ফিরিয়া গেলাম। তখন হইতে আমি আমাদের সেই নিগ্রো-বিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিযুক্ত হইলাম। আমার সুখের দিন আরম্ভ হইল—কারণ এতদিনে আমি নিগ্রোজাতির জন্য কর্ম্ম করিতে উপযুক্ত বিবেচিত হইয়াছি। এতদিন পরে আমার পল্লীবাসীদিগকে উন্নত করিবার সুযোগ পাইলাম।

 প্রথম হইতেই বুঝিলাম যে নিগ্রোসমাজে কেবল পুঁথিগত বিদ্যা প্রচার করিলে আমাদের প্রকৃত উপকার সাধিত হইবে না। কতকগুলি পুস্তক পড়িতে শিখিলেই নিগ্রোরা মানুষ হইবে না। তাহাদের সমস্ত জীবনটা নূতন ভাবে গঠন করা আবশ্যক। আমি সকাল ৮টা হইতে রাত্রি ১০টা পর্য্যন্ত খাটিতে লাগিলাম। স্কুলে পড়ান ছাড়া পল্লী ভ্রমণ এবং গ্রাম পরিদর্শন আমার কাজের মধ্যে ছিল। আমি ছাত্রদের বাড়ীতে বাড়ীতে যাইতাম। তাহাদিগকে চুল পরিষ্কার রাখিতে শিখাইতাম, দাঁত মাজিতে বলিতাম। তাহারা স্নান করিতে, পোষাক ধুইতে এবং অন্যান্য নানা কাজ করিতেও উপদেশ পাইত। নিজ হাতে তাহাদের অনেক কাজ করিয়া দিতাম। এই সকল কাজের উপকারিতাও বুঝাইয়া দিতাম। নিগ্রো-পল্লীতে এই উপায়ে স্বাস্থ্যরক্ষার এবং শরীর পালনের সরল উপায় গুলি সহজেই প্রচারিত হইতে লাগিল। স্নান করা ও দাঁত মাজার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আমি সর্ব্বদাই বক্তৃতা করিতাম। যে দিন হইতে নিগ্রোরা দাঁত মাজা আরম্ভ করিল সেই দিন হইতে তাহারা যথার্থ সভ্যতার প্রথম স্তরে পদার্পণ করিল বলিতে পারি।

 গ্রামের অনেক লোকেই স্ত্রী-পুরুষ সকলেই লেখা পড়া শিখিতে চাহিল। কিন্তু তাহারা দিবা ভাগে খাটিয়া অন্ন সংস্থান করে। কাজেই তাহাদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় খুলিলাম। প্রথম হইতেই নৈশ বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা খুব বেশী হইত। ৫০ বৎসরের বেশী বয়স্ক পুরুষ ও স্ত্রীলোকদিগের শিখিবার অধ্যবসায় দেখিয়া আশ্চর্য্য হইতাম।

 পল্লীসেবার অন্যান্য অনুষ্ঠানও আমি এই সঙ্গে আরম্ভ করিলাম। গ্রামের মধ্যে একটা গ্রন্থশালা এবং একটা আলোচনাসমিতি প্রতিষ্ঠিত করিলাম। রবিবারের জন্য কয়েকটা নূতন কাজ নির্দ্দিষ্ট করিয়া রাখিয়া ছিলাম। ম্যালডেন-নগরে একটা রবিবারের বিদ্যালয় ছিল—এবং এখান হইতে তিন মাইল দূরে আর একটা রবিবারের বিদ্যালয় ছিল। প্রতি রবিবারে এই দুইটি স্কুলেই আমি পড়াইতাম। এতদ্ব্যতীত, আমি কয়েকজন যুবককে ঘরে পড়াইয়া হ্যাম্পটনে পাঠাইবার ব্যবস্থা করিতেছিলাম এই সকল কার্য্যের জন্য অবশ্য বিদ্যালয়ের তহবিল হইতে সামান্য কিছু বেতন পাইতাম। কিন্তু বেতনের লোভেই আমি ম্যাল্‌ডেনে খাটিতাম না। নিগ্রো সমাজের উন্নতির জন্য আমার আন্তরিক ব্যাকুলতাই আমার এই কর্ম্মতৎপরতার কারণ ছিল।

 আমি যতদিন লেখা পড়া শিখিতেছিলাম, ততদিন আমার দাদা ‘জন’ আমাদের পরিবারের খরচ চালাইবার জন্য কয়লার খাদে কাজ করিয়াছেন। মাঝে মাঝে আমি তাঁহার নিকট অর্থ সাহায্যও পাইয়াছি। আমার শিক্ষা লাভের জন্য তিনি নিজের বিদ্যার্জ্জনের ইচ্ছা ত্যাগ করিয়াছিলেন। কাজেই আমি হ্যাম্পটন হইতে ফিরিয়া আসিয়া জনকে হ্যাম্পটনে পাঠাইতে কৃতসঙ্কল্প হইলাম। তিন বৎসরে তিনিও হ্যাম্পটনের বিদ্যা শেষ করিয়া আসিলেন। পরে তিনি আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ের শিল্প বিভাগের কর্ত্তা হইয়াছেন। জন যখন হ্যাম্পটন হইতে আসিলেন তখন আমরা দুই জনে মিলিয়া আমাদের পোষ্য ভাই জেম্‌স্‌কে হ্যাম্পটনে পাঠাইয়া ছিলাম। জেম্‌স্‌ও লেখা পড়া শিখিয়া আমার টাস্কেজী বিদ্যালয়ের ডাক ঘরের কর্ত্তা হইয়াছে।

 ১৮৭৬।১৮৭৭ সাল ম্যাল্‌ডেনে একরূপেই কাটিল। স্কুল পড়ান, পল্লীপর্য্যবেক্ষণ, লোকশিক্ষা ইত্যাদি নানাবিধ কাজে আমার সময় ব্যয় হইত। প্রায় এই সময়ে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ মহলে কয়েকটা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তাহারা নিগ্রোজাতির রাষ্ট্রীয় অধিকারলাভের আকাঙ্ক্ষায় বাধা দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইল। এই সমিতিগুলির নাম ছিল ‘কু ক্লুক্‌স’। গোলামীর যুগে এইরূপ কতকগুলি শ্বেতাঙ্গ সমিতি ছিল। তাহারা রাত্রিকালে নিগ্রোদিগের মহলে মহলে ঘুরিয়া পাহারা দিত। নিগ্রোরা কোন গুপ্ত পরামর্শ প্রভৃতি করিতেছে কি না ইহারা তাহার সন্ধান রাখিত। তাহাদের ন্যায় এই “কুক্লক্‌স”-সমিতিগুলিও রাত্রিকালে আমাদের উপর ডিটেকটিভের কাজ করিত। তাহারা আমাদের কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় উন্নতির বিরোধী ছিল তাহা নহে। তাহাদের দৌরাত্ম্যে আমাদের ধর্ম্মমন্দির, বিদ্যামন্দিরও টিকিতে পারিত না। তাহারা আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠানগৃহ পুড়াইয়া দিয়াছিল। আমাদের কোন কর্ম্ম কেন্দ্রই ইহাদের আমলে নিরাপদ ছিল না। বহু নিগ্রোর জীবনও নষ্ট হইয়াছিল। এই সূত্রে ম্যাল্‌ডেনে একবার একটা ছোট খাট লড়াই বাধিয়া যায়। সাদা চামড়া এবং কাল চামড়া উভয় পক্ষের লোক সর্ব্বসমেত প্রায় ২০০।২৫০ মিলিয়া মহা দাঙ্গা বাধাইয়া দিল। অনেক ভাল ভাল লোক আহত হইয়া পড়েন। আমার পূর্ব্বতন মনিব জেনারেল রাফ্‌নার নিগ্রোদিগের পক্ষ লইয়া প্রতিবাদ করিতে গিয়াছিলেন। এজন্য শ্বেতাঙ্গ কুক্লক্‌স সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁহাকে এমন জখম করিয়া দিয়াছিল যে তিনি আর সারিয়া উঠিলেন না। নিগ্রোসমাজের জন্য এই সহৃদয় শ্বেতাঙ্গ পুরুষের প্রাণ গেল।

 কুক্লক্‌সদিগের যুগ চলিয়া গিয়াছে। আর দক্ষিণ প্রান্তের শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে সদ্ভাব বাড়িয়াছে।