নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/প্রথম অধ্যায়
নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর[১]
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/6/62/Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/0/0c/Rule_Segment_-_Fancy3_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Fancy3_-_40px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/6/62/Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Wave_-_40px.svg.png)
প্রথম অধ্যায়
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/3c/Rule_Segment_-_Flare_Left_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Flare_Left_-_40px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/3/3d/Rule_Segment_-_Diamond_open_-_7px.svg/7px-Rule_Segment_-_Diamond_open_-_7px.svg.png)
![](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/5/51/Rule_Segment_-_Flare_Right_-_40px.svg/40px-Rule_Segment_-_Flare_Right_-_40px.svg.png)
গোলামাবাদের আব্হাওয়া
আমি কেনা গোলাম—জাতিতে নিগ্রো। ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের ফ্রাঙ্কলিন জেলার কোন গোলাম-খানায় আমার জন্ম। ঠিক কবে কোথায় জন্মিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। শুনিয়াছি একটা ডাকঘরের নিকটে আমার জন্মস্থান; এবং বোধ হয় ১৮৫৮ কিম্বা ১৮৫৯ সালে আমি ভূমিষ্ঠ হই। কিন্তু জন্মের মাস, তারিখ ইত্যাদি কিছুই জানি না। নিতান্ত ছেলেবেলার কথার মধ্যে গোলামাবাদের কাজকর্ম্ম ও চালচলনগুলিই মনে পড়ে। আর স্মরণ হয় সেই আবাদের গোলামমহাল্লার কুঠুরিগুলি—যেখানে আমার স্বজাতিরা তাহাদের দাসজীবন কাটাইত।
নিতান্ত ঘৃণ্য, অবনত, দারিদ্র্যদুঃখময়, নৈরাশ্যপূর্ণ অবস্থার মধ্যেই আমার বাল্য-জীবন কাটিয়াছে। অবশ্য এই দুঃখ দৈন্যক্লেশের জন্য আমার মনিবদের বিশেষ কোন দোষ ছিল না। তাঁহারা অন্যান্য প্রভুগণের তুলনায় সহৃদয় ও দয়ালুই ছিলেন। তবে কেনা গোলামমাত্রের যে শোচনীয় দশা তাহাই আমাকেও ভোগ করিতে হইয়াছে। একটা ১৬ ফিট লম্বা এবং ১৪ ফিট চৌড়া কাঠের কামরার মধ্যে দাস-জাতির সকলকেই বসবাস করিতে হইত। এইরূপ একটা কুঠুরিতে আমি, আমার মাতা, এবং এক ভাই ও ভগ্নী এই চারিজন আমাদের দাস-জীবন কাটাইতাম। পরে,“যুক্তরাজ্যে”র গৃহবিবাদের ফলে দাসজাতির স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। তখন হইতে আমরা স্বাধীন হইয়া গোলামখানা পরিত্যাগ করিয়াছি।
আমার পূর্ব্বপুরুষদের কথা কিছুই জানি না। গোলামাবাদের লোকজনেরা মাঝে মাঝে কাণাঘুষা করিত। তাহা হইতে অল্প-বিস্তর কিছু অনুমান করিয়া লইয়াছি মাত্র। আমরা আফ্রিকাবাসী। আফ্রিকা হইতে আমেরিকায় চালান দিবার সময়ে জাহাজে আমাদের পূর্ব্বপুরুষদিগকে মনিব-সম্প্রদায়ের লোকজনেরা যথেষ্ট কষ্ট দিয়াছিল। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বৃত্তান্ত এইটুকু মাত্র জানা যায়। বলা বাহুল্য সেই যুগে গোলামজাতির বংশতালিকা, পুরাতত্ত্ব, পিতামহের জীবন-কাহিনী ইত্যাদি সংগ্রহ করিবার কোন প্রয়োজনই বোধ হইত না।
কোন উপায়ে এক ব্যক্তি আমার মাতাকে হয়ত কিনিয়া আনিয়াছিলেন। তাহার পর হইতে তিনি আমাদের প্রভু হর্ত্তাকর্ত্তা-বিধাতা। একটা নূতন গরু, ঘোড়া বা শূকর কিনিলে তাঁহার পরিবারে যেরূপ সাড়া পড়ে, আমার মাতা তাঁহাদের গোলামাবাদে প্রবেশ করিলে তাহা অপেক্ষা বেশী কিছু হৈ-চৈ পড়ে নাই।
আমার পিতার সংবাদ আমি একেবারেই কিছু জানি না। বোধ হয় তিনি কোন শ্বেতকায় পুরুষ—সম্ভবতঃ নিকটবর্ত্তী কোন আবাদের প্রভু-জাতীয় একব্যক্তি। তাঁহাকে আমি কখন দেখি নাই—তাঁহার নাম পর্য্যন্ত শুনি নাই, তিনি আমাকে মানুষ করিবার জন্য কোনরূপ চেষ্টাও কোন দিন করেন নাই। এইরূপ পিতা বা জন্মদাতা গোলামীর যুগে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ-সমাজে অসংখ্যই ছিলেন।
আমাদের কামরাটিতে কেবল মাত্র আমাদেরই গৃহস্থালী চলিত না। এই কুঠুরিটিতে সমস্ত গোলামাবাদের জন্য রন্ধনকার্য্য সম্পন্ন হইত। আমার মাতা আবাদের সকল কুলীর জন্যই রান্না করিতেন। ঘরটা নিতান্তই জীর্ণ-শীর্ণ অতিশয় অস্বাস্থ্যকর এবং পীড়াজনক। ইহার ভিতর আলোক বা বাতাস বেশী আসিত না। কিন্তু মাঝে মাঝে ফাঁকের ভিতর দিয়া শীতকালের ঠাণ্ডা বাতাস যথেষ্ট প্রবেশ করিত। তাহার উপর, মেজেতে অনেকগুলি গর্ত্ত ছিল—তাহার মধ্যে একাধিক বিড়াল আসিয়া আশ্রয় লইত। মেজের উপর কোন কাঠের আবরণ ছিল না। মাটির উপরেই সকল কাজ-কর্ম্ম চলিত। মেজের মধ্যস্থলে একটা বড় গর্ত্ত করা হইয়াছিল। শীতকালে তাহার মধ্যে শকরকন্দ আলু রাখিয়া একটা কাঠের তক্তা দিয়া ঢাকা হইত। এই আলুগুদামের কথা আমার বেশ মনে আছে। এখান হইতে নাড়াচাড়া করিবার সময় দুই চারিটা আলু আমার হস্তগত হইত। সেইগুলি পরে নির্জ্জনে পুড়াইয়া খাইতাম।
রন্ধনাদির সরঞ্জাম অতি কদর্য্য রকমেরই ছিল। ‘ষ্টোভ’ দেওয়া হইত না। খোলা উননে রান্না করিতে হইত। ফলতঃ শীতকালে যেমন ঠাণ্ডা বাতাসের দৌরাত্ম্যে প্রাণে বাঁচা কঠিন হইত, তেমনি গ্রীষ্মকালে এই খোলা উননের উত্তাপ আমাদের জীবনধারণ অসম্ভব করিয়া তুলিত।
আমার বাল্যজীবনে এবং অন্যান্য হাজার হাজার গোলামের বাল্যজীবনে কোন প্রভেদই ছিল না। আমাকে এবং আমার ভাই ও ভগ্নীকে দিবাভাগে কখনই মাতা দেখিতে শুনিতে সময় পাইতেন না। খুব সকালে সরকারী কাজে হাত দিবার পূর্ব্বে এবং রাত্রে সকল কাজ সারিবার পর আমার মাতা আমাদিগের জন্য কিছু সময় করিয়া লইতেন। মনে পড়ে কোন কোন দিন রাত্রে আমার মাতা আমাদিগকে জাগাইয়া কিছু মাংস খাওয়াইতেন। কোথায় যে তিনি তাহা পাইতেন কিছুই জানিতাম না। অবশ্য আমার মনিবেরই পশুশালা হইতে জন্তুটি লইয়া আসা হইত। এই কার্য্যকে আপনারা ‘চুরি’ বলিবেন। আমিও আজকাল ইহাকে চুরিই বলিয়া থাকি। তবে যখনকার কথা বলিতেছি, তখন ইহাকে কোন দিনই চুরি ভাবিতে পারি নাই, এবং কেহ আমাকে বুঝাইতেও পারিত না যে আমার মাতা চোর। গোলামী করিলে এইরূপই ঘটিয়া থাকে। দাস-জাতির ইহা স্বধর্ম্ম।
ছেলে-বেলায় আমরা কোন দিন বিছানায় শুইয়াছি বলিয়া মনে হয় না। আমরা তিন ভাই বোন মাটিতে পড়িয়া থাকিতাম। কতকগুলি ছেঁড়া ময়লা ন্যাক্ড়ার বস্তার উপরে রাত্রি কাটাইতাম।
সম্প্রতি কেহ কেহ আমার বাল্যজীবনের খেলা-ধূলার কথা শুনিতে চাহিয়াছেন। খেলা-ধূলা কাহাকে বলে ছেলে-বেলায় আমি তাহা জানিতাম না। যতদূর স্মরণ করিতে পারি—প্রথম হইতে এখন পর্য্যন্ত চিরকাল খাটিতে খাটিতেই আমার জীবন চলিয়াছে। কিছু খেলিতে পাইলে বোধ হয় আজকাল বেশী কাজই করিতে পারিতাম।
মিগ্রোজাতির গোলামীর যুগে আমার বয়স নিতান্তই অল্প ছিল। আমার দ্বারা বেশী কাজ হইতে পারিত না। তথাপি আমাকে আবাদের অনেক কাজই করিতে হইত। আমি উঠান ঝাড়িতাম—এবং কৃষিক্ষেত্রের চাষীদের কাজের জন্য জল যোগাইতাম। অধিকন্তু কলে পিষিবার জন্য সপ্তাহে একবার করিয়া শস্যাদি বহিয়া লইয়া যাইবার ভার আমার উপর ছিল। এই কার্য্য বড়ই কষ্টদায়ক হইয়া উঠিত। আবাদ হইতে কল তিন মাইল দূরে। একটা ঘোড়ার পীঠের উপরে শস্যের প্রকাণ্ড বোঝা চাপান হইত—বোঝাটা ঘোড়ার দুই পার্শ্বে ঝুলিতে থাকিত। আমি মধ্যস্থলে বসিতাম। মাঝে মাঝে দুর্দ্দৈবক্রমে বোঝাটা ঘোড়ার পীঠ হইতে পড়িয়া যাইত—আমিও চীৎপাত হইয়া পড়িতাম। আমার সাধ্য ছিল না যে আমি একা সেই বোঝা অশ্বপৃষ্ঠে তুলি। একাকী নির্জ্জন রাস্তায় বহুক্ষণ বসিয়া থাকিতাম—কাঁদিয়া কাটাইতাম। হঠাৎ কোন লোক সেই দিক দিয়া গেলে তাহার সাহায্যে মাল ঘোড়ায় চড়াইয়া কলে পৌঁছিতাম। ইহাতে সময়ে সময়ে এতক্ষণ লাগিত যে কলে কাজ সারিয়া গৃহে ফিরিতে বেশ রাত্রি হইয়া যাইত। অন্ধকারপথে বড়ই ভয় পাইতাম। স্থানে স্থানে ঘন জঙ্গল ছিল—তাহার মধ্যে না কি চাকুরী ত্যাগ করিয়া শ্বেতাঙ্গ সৈন্যাদি বাস করিত। শুনিয়াছিলাম—একা পাইলেই তাহারা নিগ্রো বালকের কাণ কাটিয়া রাখিত। সুতরাং ঐ রাস্তায় যাওয়া-আসা আমার পক্ষে বিষম উৎপাত বোধ হইত। বিশেষতঃ বেশী রাত্রে ঘরে ফিরিলে আবার জুতা লাথি গালি খাওয়ার সুব্যবস্থাও ছিল।
গোলামী করিতে করিতে আমি কখনও শিক্ষালাভের জন্য বিদ্যালয়ে যাই নাই। অবশ্য বিদ্যালয়-গৃহের ফটক পর্য্যন্ত অনেকবারই গিয়াছি। আমার মনিবদের সন্তান-সন্ততিরা স্কুলে যাইত। আমি তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে পুস্তকাদি বহিয়া লইতাম। দূর হইতে দেখিতাম বিদ্যালয়ের ঘরগুলিতে ছেলে-মেয়েরা দলে দলে লেখা পড়া শিখিতেছে। সেই দৃশ্য আমার চিত্তে কি অপূর্ব্ব ভাবই না সৃষ্টি করিত! ঐরূপ একটা গৃহে প্রবেশ করিয়া লেখাপড়া করিতে পারা আমার নিকট স্বর্গ-প্রবেশের ন্যায় সুখকর মনে হইত।
আমরা যে গোলাম বা ক্রীতদাস তাহা আমি অনেকদিন পর্য্যন্ত জানিতাম না। আমাদিগকে স্বাধীন করিয়া দিবার জন্য দেশব্যাপী যে আন্দোলন চলিতেছিল তাহাও বুঝিতে পারি নাই। একদিন সকালে জাগিয়া দেখি আমার মাতা আমাদিগকে সম্মুখে রাখিয়া ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিতেছেন:—“হে জগদীশ্বর, সেনাপতি লিঙ্কল্নের সৈন্যদল যেন জয়লাভ করে। হে অনাথের নাথ, আমরা সপরিবারে এবং সদলবলে যেন স্বাধীন হই। হে পতিত-পাবন, এই অবনত দাসজাতিকে বন্ধন-মুক্ত কর।”
বলা বাহুল্য, গোলামাবাদের আমার স্বজাতিরা সকলেই নিরক্ষর ছিল। কেহই লেখাপড়া, পুস্তক, গ্রন্থালয়, সংবাদপত্র ইত্যাদির ধার ধারিত না। তথাপি দেখিতাম প্রায় সকলেই দেশের কথা বেশ জানিত ও বুঝিত। যুক্তরাজ্যের মধ্যে যে একটা বিরাট বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে তাহা কাহারই অজানা ছিল না। কবে কোথায় কি ঘটিতেছে দাসজাতির সকলেই তাহা বুঝিতে ও শুনিতে পাইত। আমাদিগকে স্বাধীন করিবার জন্য যুক্তরাজ্যের উত্তরপ্রান্তবাসী গ্যারিসন, লাভজয় ইত্যাদি মানবসেবকগণ যে দিন হইতে আন্দোলন শুরু করেন,—আশ্চর্য্যের বিষয় সেইদিন হইতেই দক্ষিণপ্রান্তের গোলামাবাদের মহলে মহলে সংবাদ রটিয়া গেল। স্বাধীনতার আন্দোলনের দৈনিক ঘটনাগুলি গোলাম-সমাজে সুপ্রচারিত হইত।
উত্তর প্রান্তে এবং দক্ষিণ প্রান্তে এই বিষয় লইয়া লড়াই হইবার উপক্রম হইল। দক্ষিণ প্রান্তের মনিবেরা গোলামের জাতিকে স্বাধীনতা দিতে নিতান্তই নারাজ। শেষ পর্য্যন্ত দুই প্রান্তে সংগ্রাম বাধিল। এ সকল কথা গোলামেরা—আমার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবগণ—অতি সহজেই বুঝিতে পারিত। তাহারা এই আন্দোলন ও সংগ্রামের যুগে কত রাত্রিই যে কাণাঘুষায়, গল্পগুজবে ও গুপ্ত পরামর্শে কাটাইয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই।
আমাদের গোলামাবাদ রেলের রাস্তা হইতে বহুদূরেই অবস্থিত ছিল—ইহার নিকট কোন বড় সহরও ছিল না। কিন্তু আমরা খবর পাইতাম যে, উদারহৃদয় সেনাপতি লিঙ্কল্ন্ যুক্তরাজ্যের সভাপতি হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছেন। সেই সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বুঝিতাম যে তিনি সভাপতি হইলে আমরা স্বাধীন হইব। তাহার পর যখন যুদ্ধ বাধিল, তখনও বুঝিতে পারিয়া ছিলাম যে, এই যুদ্ধের ফলের উপর আমাদেরই ভাগ্য নির্ভর করিতেছে। বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, লিঙ্কল্ন্ এবং তাঁহার উত্তরপ্রান্তবাসী জনগণ যদি দক্ষিণপ্রান্তবাসীদিগকে যুদ্ধে পরাস্ত করিতে পারেন, তাহা হইলে দাসজাতির গোলামী ঘুচিয়া যাইবে। এজন্য এই সংগ্রামের জয়-পরাজয়ের খবর, পাইতে আমরা অতিশয় আগ্রহান্বিত হইতাম।
ভগবানের কৃপায় আমরা সকল সংবাদই পাইতাম। এমন কি, আমাদের প্রভুরা খবর পাইবার পূর্ব্বেই অনেক সময়ে ব্যাপার বুঝিয়া লইতাম। কথাটা কিছু হেঁয়ালির মত বোধ হইবে বটে, কিন্তু রহস্য আর কিছুই নয়। শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের পরনির্ভরতাই আমাদের এ বিষয়ে বিশেষ উপকার করিত। আমরা তাঁহাদের গোলাম সত্য, কিন্তু আমাদের মনিবেরাও অনেক বিষয়ে আমাদেরই গোলাম ছিলেন। আমাদের সাহায্য না পাইলে তাঁহাদের এক পাও চলিবার ক্ষমতা ছিল না। গোলামেরাই ডাকঘর হইতে চিঠিপত্র লইয়া আসিত। সপ্তাহে দুই বার করিয়া ডাকঘরে যাওয়া-আসা করিতে হইত। সেই সুযোগে ডাকঘরের নিকট জটলা ও মজলিশ এবং খোসগল্প ইত্যাদি হইতে দাস-পত্রবাহক সকল অবস্থা বুঝিয়া লইত। ফলতঃ, প্রভুরা চিঠিপত্র পাঠ করিয়া বৃত্তান্ত জানিতে পারিবার পূর্ব্বেই গোলামমহল্লায় সংবাদ প্রচারিত হইয়া পড়িত।
মায়ে ভায়ে সকলে এক সঙ্গে বসিয়া কখনও আমি আহার করিয়াছি—এরূপ মনে হয় না। গোলামখানার খাওয়া কোন উপায়ে নাকে চোখে গোঁজা মাত্র। তাহাকে আহার বলে না। গরু ছাগল ইত্যাদি যেরূপ চরিয়া বেড়ায় এবং যেখানে যাহা পায় তাহাই খায়, আমাদেরও ভোজনব্যাপার সেইরূপই ছিল। কোন সময়ে কাজ করিতে করিতে হয়ত একটুকরা মাংস খাইলাম। কখনও বা দুই একটা পোড়ান আলু হাঁটিতে হাঁটিতে চিবাইতে হইত। মাঝে মাঝে উননের কড়া হইতেই তুলিয়া কোন দ্রব্য মুখে দিতাম। কাঁটা চামচ ইত্যাদির প্রয়োজন হইবে কোথা হইতে? ঠিক নিয়মিতরূপে যথাবিধি পানভোজনেরই যে ব্যবস্থা ছিল না! যখন কিছু বড় হইলাম, তখন বড় কুঠির সাহেব প্রভুর আহারের সময়ে পাখা টানিতে নিযুক্ত হইয়াছিলাম। এই উপায়ে মাছি তাড়াইতে তাড়াইতে মনিবপরিবারের কথোপকথন শুনিতে পাইতাম। অনেক সময়ে গুপ্তকথাও বাহির হইয়া পড়িত। লড়াই সম্বন্ধে তাঁহাদের মতামত বুঝিতে পারা যাইত। সময়ে সময়ে তাঁহাদের খানা দেখিয়া যথেষ্ট লোভও হইত। আর মনে হইত কোনও দিন ঐরূপ এক থালা অন্নব্যঞ্জন যদি আমার ভাগ্যে জুটে, তাহা হইলে আামার স্বাধীনতার চূড়ান্ত ফললাভ হইবে!
সংগ্রাম চলিতে লাগিল। আমার শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের খাওয়াপরার বড়ই কষ্ট হইল। দূরদেশ হইতে চা, কাফি, চিনি ইত্যাদি আসিলে তবে মনিবদের গৃহস্থালী চলে। কিন্তু ক্রমশঃ এ সব দুর্ল্লভ হইল। তাঁহাদের দুঃখের আর সীমা রহিল না। গোলামজাতির কিন্তু বিশেষ কোন অসুবিধা হয় নাই। কারণ আমরা অত পরমুখাপেক্ষী ত ছিলাম না। আমাদের আবাদেই যে সব শস্য জন্মিত তাহাতেই আমাদের ভরণ-পোষণ স্বচ্ছন্দে চলিত। আর শূকর পালন ত সহজেই আমরা নিজ মহাল্লায় করিতাম। কাজেই লড়াই বাধিবার পর প্রভুদের দুর্গতি দেখিয়া আমরা বিব্রত হইলাম। আমাদের অবস্থা ‘যথাপূর্ব্বং তথাপরং’। তাঁহারা অনেক সময়ে বাধ্য হইয়া চিনির পরিবর্ত্তে ময়লা গুড় দিয়াই চা খাইতেন। অনেক সময়ে আবার সেই গুড়ও যোগাইতে পারিতাম না। মিষ্ট না দিয়াই তাঁহাদিগকে অনেক দিনে চা পান করিতে হইয়াছে। আবার যখন প্রকৃত চা বা কাফিও থাকিত না, তখন তাঁহারা মুড়ি বা চিঁড়ে ভাজা অথবা অন্য কোন শস্যের গুঁড়া ভিজাইয়া ‘দুধের সাধ ঘোলে’ মিটাইতেন।
আমি জীবনে সর্ব্বপ্রথম যে জুতা পরি, তাহা কাঠের তৈয়ারী। উপরিভাগে কিছু চামড়া ছিল। তাহা পরিতে পায়ের তলায় বড়ই লাগিত। কাঠের জুতা তবুও ভাল—কিন্তু গোলামীর আমলে আমাদিগকে যে জামা পরিতে হইত তাহা অতি ভয়ঙ্কর। বোধ হয় দাঁত টানিয়া তুলিতে যে কষ্ট হয় এই জামা পরিতে তাহা অপেক্ষা কম কষ্ট হইত না। ভার্জ্জিনিয়ার গোলামাবাদে খুব মোটা খড়্খড়ে চটের শার্ট পরিতে দেওয়া হইত। ইহার নূতন অবস্থায় অসংখ্য কাঁটা বাহির হইয়া থাকিত। গায়ের চামড়ায় কাঁটাগুলি বিঁধিয়া অসহ্য যন্ত্রণা দিত। আমার চামড়া কিছু নরম—সেজন্য কষ্ট অত্যধিকই বোধ করিতাম। কি করিব?—বাদবিচারের অবসর ছিল না। তাহাই পরিতে হইবে নতুবা অন্য কোন গাত্রাচ্ছাদন পাইব না। আমার দাদা ‘জন’ একবার দাসমহলের পক্ষে অসামান্য উদারতা দেখাইয়াছিল। চটের নূতন জামা পরিতে আমার কষ্ট দেখিয়া সে নিজেই ১০।১৫ দিন সেটা পরিল। যখন ভিতরকার কাঁটাগুলি তাহার গায়ে লাগিয়া ঘষিয়া গেল, তখন হইতে আমি সেই জামাটা ব্যবহার করিতে লাগিলাম। এই জামাই আমার গোলামী যুগের বহুকাল পর্য্যন্ত একমাত্র পোষাক ছিল।
আমাদের দুরবস্থার এই শোচনীয় কাহিনী শুনিয়া আপনারা ভাবিতে পারেন—বোধ হয় দক্ষিণপ্রান্তের কাল গোলামেরা তাহাদের শ্বেতাঙ্গ মনিবদের উপর বড়ই বিরক্ত ছিল। সত্য কথা বলিতে পারি যে, আমরা তাঁহাদের সম্বন্ধে কখনই বেশী তীব্রভাব পোষণ করি নাই। আমরা জানিতাম যে তাঁহারা আমাদিগকে চিরকাল গোলামের অবস্থায় রাখিবার জন্যই উত্তরপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গ মহোদয়দিগের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত। আমরা জানিতাম যে, আমাদের মনিবেরা জিতিলে আমরা চিরজীবন গোলামীই করিতে থাকিব। তথাপি আমরা আমাদের প্রভুদের প্রতি শত্রুতাচরণ করি নাই—বরং সকল সময়ে তাঁহাদের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হইয়াছি। আমরা কোনদিনই তাঁহাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনার ত্রুটি করি নাই। যুদ্ধে আমার একজন যুবক মনিব মারা যান, এবং দুইজন আহত হন। ইঁহাদের পরিবারের যতটা দুঃখ হইয়াছিল—এই ঘটনায় গোলামখানায় তদপেক্ষা কম দুঃখ হয় নাই। আমার আহত প্রভুদ্বয়কে প্রাণপণে সেবাশুশ্রূষা করিয়াছি। কত রাত্রি তাঁহাদের রোগশয্যার পার্শ্বেও কাটাইয়াছি। তাহা ছাড়া, যখন আমাদের প্রভুপরিবারের পুরুষেরা সকলেই লড়াই করিতে বাহির হইয়া যাইতেন তখন আমরাই তাঁহাদের গৃহের প্রহরী থাকিতাম,— তাঁহাদের স্ত্রীপুত্রদিগকে রক্ষা করিতাম। সমস্ত পরিবারের ‘ইজ্জৎ’ এবং সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের হাতেই থাকিত। নিগ্রোজাতির সত্যনিষ্ঠা, হৃদয়বত্তা এবং কর্ত্তব্যপরায়নতার আর কোন প্রমাণ আবশ্যক কি?
অধিক কি, নিগ্রোরা অনেকক্ষেত্রে তাঁহাদের পূর্ব্ব মনিবদিগকে অন্নবস্ত্র দিয়া মানুষও করিয়াছে। চিরদিন সকলের সমান যায় না। আজ যে রাজা কাল সে গোলাম, আজ যে দাস কাল সে প্রভু। সুখদুঃখ চক্রের মত ঘুরিতেছে। দক্ষিণপ্রান্তের শ্বেতাঙ্গ প্রভুসম্প্রদায়ের অনেকেই যুদ্ধের ফলে নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছিলেন। আমি জানি সেই দুঃখের সময়ে তাঁহাদের পূর্ব্বর্তন গোলামেরা তাঁহাদিগকে অর্থ সাহায্য করিত। আমি জানি এইরূপে গোলামজাতির দানে মনিব-সন্তানসন্ততিরা লেখাপড়া শিখিয়াছে। একজন মনিব-পুত্র চরিত্রহীনতার ফলে ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়ে। আমি জানি গোলামেরা নিজেদের দারিদ্র্য সত্ত্বেও চাঁদা তুলিয়া এই পাপাত্মা প্রভু-সন্তানকে বাঁচাইয়া রাখিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। কেহ তাঁহাকে কাফি পাঠাইয়া দেয়, কেহ বা চিনি কেহ বা মাংস দেয়। এই দানের উপর নির্ভর করিয়া সেই ব্যক্তি এখনও জীবন ধারণ করিতেছে। পুরাতন মনিবের পুত্ত্র বা দূর আত্মীয় বলিয়া যদি কোন ব্যক্তি নিগ্রোর নিকট আসিয়া উপস্থিত হয় এবং নিজের কষ্ট জ্ঞাপন করে, তাহা হইলে, আমি সদর্পে বলিতে পারি, দক্ষিণপ্রান্তে এমন কোন নিগ্রো নাই যে, তাহাকে যথাসাধ্য সাহায্য না করিবে। নিগ্রোজাতির কি হৃদয় নাই?—নিগ্রোজাতির কি কৃতজ্ঞতা নাই? কাল চামড়ার ভিতর কি পরমাত্মার সিংহাসন নাই?
আমি বলিলাম নিগ্রোরা কখনও অবিশ্বাসী ও বিশ্বাসঘাতক হয় নাই। তাহারা ধর্ম্মভীরু, কৃতজ্ঞ, কর্ত্তব্যনিষ্ঠ। তাহারা কথার দাম বুঝে, কোন প্রতিজ্ঞা করিলে তাহা ধর্ম্মবৎ পালন করে। একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশের একটি কাল গোলাম তাহার মনিবের সঙ্গে একটা চুক্তি করিয়া লইয়াছিল। তাহার সর্ত্তে সে নিজে মনিবের আবাদে না খাটিয়া তাহার পরিশ্রমের মূল্যস্বরূপ কিছু টাকা বৎসর বৎসর মনিবকে দিতে প্রতিশ্রুত হয়। সেই টাকা সংগ্রহ করিবার জন্য এইব্যক্তি ওহায়ো প্রদেশে স্বাধীনভাবে মজুরি করিত। বৎসর বৎসর ভার্জ্জিনিয়ায় যাইয়া, প্রভুর হাতে তাঁহার প্রাপ্য টাকা গুণিয়া দিত। ইতি মধ্যে লড়াই বাধে—লড়াইয়ের ফলে সমগ্র দাস জাতিকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়। পুরাতন চুক্তি, প্রতিজ্ঞা, বন্দোবস্ত ইত্যাদি সবই ভাঙ্গিয়া ফেলা হয়। কোন প্রভুই তাঁহার পূর্ব্বর্তন কোন গোলামকে কোন বিষয়ের জন্যই ধরিয়া বাঁধিয়া রাখিতে বা খাটাইতে পারিবেন না—এই আইন যুক্তরাজ্যের মন্ত্রণাসভা হইতে জারি হয়। সুতরাং এই গোলামটি যদি এই সুযোগে তাহার পুরাতন চুক্তি অমান্য করিত এবং প্রভুকে বাকী টাকা দিতে অস্বীকার করিত, তাহা হইলে কোন আইনে তাহাকে দোষী সাব্যস্থ করা যাইত না। কিন্তু আপনারা শুনিয়া আশ্চর্য্য হইবেন যে এই ব্যক্তি যত দিন পর্য্যন্ত তাঁহার ঋণ পরিশোধ করিতে না পারিয়াছিল, ততদিন পর্য্যন্ত পূর্ব্বেকার প্রতিজ্ঞা মত ভার্জ্জিনিয়ায় যাইয়া প্রভুর নিকট টাকা দিয়া আসিত। এমন কি, সুদের শেষ কপর্দ্দক পর্য্যন্তও সে দিয়া আসিয়াছিল। প্রতিজ্ঞার মূল্য নিগ্রোরা বুঝে না কি? এই কৃষ্ণকায় নিগ্রো বুঝিয়াছিল যে, সে স্বাধীন হইয়াছে বটে, প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিলে এখন তাহার কোন দোষই হইবে না। কিন্তু সে শারীরিক স্বাধীনতা অপেক্ষা চিত্তের ও আত্মার স্বাধীনতাকেই বেশী সম্মান করিল। সমাজে স্বাধীনভাবে বিচরণ করিবার পূর্ব্বে সে আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্জ্জন করিয়া লইল।
তবে কি নিগ্রোরা স্বাধীনতা চাহিত না? গোলামের জাতি গোলামীগিরিতেই কি তন্ময় হইয়া গিয়াছিল? গোলামী ছাড়াইয়া উঠিতে কি আমার স্বজাতিরা ইচ্ছাই করিত না? প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাদের হৃদয়ে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা অতিশয় বলবতীই ছিল। আমি এমন একজন নিগ্রোকেও জানি না যে স্বাধীন হইতে ইচ্ছা করিত না। আমি এমন একজন গোলামেরও কথা শুনি নাই যে গোলামীতেই লাগিয়া থাকিতে চাহিয়াছিল।
দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ দুর্ভাগ্য জাতি মাত্রেরই দুঃখ দেখিয়া আমি মর্ম্মে মর্ম্মে কষ্ট অনুভব করি। এইরূপে শৃঙ্খলিত জাতির অশেষ দুরবস্থা। কোন কারণে একবার পরাধীন হইয়া গেলে সে জাতি শীঘ্র সেই অবস্থা কাটিয়া উঠিতে পারে না। তাহাদের সমাজ-বন্ধন, তাহাদের পারিবারিক জীবন সকলই এই পরাধীনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়াইয়া যায়। অন্নসংস্থানের উপায়গুলিও এই দাসত্বের সর্ব্বমুখী প্রভাবের অধীন হইয়া পড়ে। চলিতে ফিরিতে গেলেও সেই প্রভাব ভুলিয়া থাকা যায় না। কাজেই দাসজাতির পক্ষে স্বাধীনতা লাভকরা বড় সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আমি এই কারণে আমার প্রভুদের সম্বন্ধে কখনও কোন শত্রুভাব পোষণ করি নাই। দাসত্ব অনেকটা জীবনযাপনের স্বাভাবিক আবহাওয়ার মধ্যেই দাঁড়াইয়া গিয়াছিল। দাসত্ব প্রথা বাদ দিয়া সেই যুগের যুক্তরাজ্যে কোন অনুষ্ঠানই চলিতে পারিত না। যুক্ত রাজ্যের কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য, সমাজ, ধর্ম্ম সবই গোলামী-প্রতিষ্ঠানকে অবলম্বন করিয়া গড়িয়া উঠিতেছিল। ফলতঃ এই গোলামীগিরিকে দোষ দেওয়া সত্যসত্যই বড় অবিচারের কার্য্য।
এমন কি, আমি এ কথা বলিতেও বাধ্য যে, গোলামীর ফলে নিগ্রোজাতির যথেষ্ট উপকারই সাধিত হইয়াছে। দাসত্বের আবহাওয়ায় আমাদের অতি উচ্চ অঙ্গের শিক্ষালাভ হইয়াছে। আমাদের শরীর ও স্বাস্থ্য অনেকটা পুষ্ট হইয়াছে—আমরা নিয়মিতরূপে প্রণালীবদ্ধভাবে কাজ করিতে শিখিয়াছি। আমাদের কর্ম্মপটুত্ব জন্মিয়াছে। আমরা অনেকটা চিন্তাশীল হইয়াছি। কৃষি ও শিল্পবিদ্যার আমাদের ‘হাতে-কলমে’ শিক্ষালাভ হইয়াছে। আমাদের নৈতিক চরিত্রও কিছু গঠিত হইয়াছে—ধর্ম্মভাবও জাগিয়াছে। আমেরিকার গোলামাবাদগুলির-আব্হাওয়া আমাদের পক্ষে প্রকৃত প্রস্তাবে একটি বিদ্যালয়স্বরূপই ছিল। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মনিবদিগকে এজন্য আমি সর্ব্বদা সম্মান করিয়াই আসিয়াছি।
আমি গোলামী-প্রথার পক্ষপাতী নহি—দাসত্ব-প্রথা ভাল এ কথা আমি বলিতে চাহি না—সংসারে গোলামীগিরির আবশ্যকতাও আমি স্বীকার করিতে পারিব না। আমি জানি আমার প্রভুরা আমাদিগকে ধর্ম্মভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া দাসত্ব-শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেন নাই। আমি জানি যে তাঁহারা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যই আমাদিগকে গোলাম করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমি জানি—আমরা যে কোন দিন মানুষ হইয়া উঠিব তাহা ইঁহারা স্বপ্নেও ভাবেন নাই—এবং মানুষ করিয়া তুলিবার জন্য সজ্ঞানে কোন চেষ্টাও করেন নাই। আমি কেবল এই মাত্র বলিতে চাহি যে, ভগবানের কর্ম্মকৌশল বিচিত্র। জগদীশ্বর যাহা করেন সবই মঙ্গলের জন্য। প্রথম দৃষ্টিতে যাহা তিক্ত ও কঠোর, পরিণামে তাহাই মধুময় ফল প্রসব করে। আমাদের অজ্ঞাতসারে এই উপায়ে জগতের মহৎকর্ম্মগুলি নিষ্পন্ন হইয়া যায়। ভগবানের অপার করুণায় বিশ্বে কত অসম্ভব সম্ভব হইতেছে। মানুষ, অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিধাতার মঙ্গলহস্তে যন্ত্রের ন্যায় চালিত হইয়া তাঁহারই ইচ্ছা পূর্ণ করিতেছে। এই আশাতত্ত্ব প্রচার করিবার জন্য এত কথা বলিলাম।
আজ কাল লোকেরা আমার জিজ্ঞাসা করে—“তুমি এই ঘোরতর দৈন্য, অজ্ঞতা, ও কুসংস্কাররাশির মধ্যে থাকিয়াও নিগ্রোজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিরূপে এত আশান্বিত?” আমার একমাত্র উত্তর এই যে, আমি ভগবানের মঙ্গলবিধানে বিশ্বাসবান্। যাঁহার করুণায় নানা দুর্দ্দৈবের ভিতর দিয়া আমরা এতদূর উঠিয়াছি তাঁহারই করুণায় আমরা আরও উন্নত হইব। নিগ্রো-জাতি জগতের বিরাট কর্ম্মক্ষেত্রে তাহার স্বকীয় কৃতিত্ব দেখাইয়া জগদীশ্বরের অসীম ক্ষমতার পরিচয় দিবে।
আমি বলিলাম গোলামীর ফলে আমাদের যথেষ্ট উপকার হইয়াছে। অবশ্য অপকারও কম হয় নাই। কিন্তু আমার বিশ্বাস—আমাদের শ্বেতাঙ্গ প্রভু মহোদয়গণেরই ক্ষতি বেশী হইয়াছে। মনিব মহাশয়েরা বিলাসে ডুবিতে লাগিলেন। শারীরিক পরিশ্রম তাঁহাদের কষ্টকর বোধ হইত। বড় মহলে খাটিয়া খাওয়া একটা নিন্দনীয় কার্য্য বিবেচিত হইত। ক্রমশঃ তাঁহারা সকল বিষয়ে স্বাবলম্বন, এবং আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারাইলেন। প্রভুগণের সন্তানেরা কেহই কোন কৃষি বা শিল্পের পটুত্ব লাভ করিতে শিখিল না। মনিবের কন্যারা কেহই রাঁধিতে, শেলাই করিতে অথবা ঘর ঝাড়িতেও শিখিল না। সকল কাজই দাসেরা করিত। কিন্তু গোলামদিগের স্বার্থ আর কতটুকু? তাহারা কোন উপায়ে কাজ সারিয়া মনিবকে সন্তুষ্ট করিতে চেষ্টা করিত মাত্র। সুচারুরূপে বুদ্ধি খাটাইয়া কাজ করিতে দাসেরা শিখিত না। ফলতঃ, প্রভুপরিবারে কোন শৃঙ্খলা দেখিতে পাইতাম না। লক্ষ্মীশ্রী যাহাকে বলে মনিবমহলের গৃহস্থালীতে তাহার পরিচয় পাওয়া যাইত না। ঘর ভালরূপ পরিষ্কৃত থাকিত না। জানালার খড়খড়িগুলি ভগ্নাবস্থায় বহুদিন পড়িয়া থাকিত। জানালার খিল না থাকিলে তাহা লাগাইবার জন্য কেহই মাথা ঘামাইত না। যাহা যেখানে পড়িত তাহা সেখানে সেই অবস্থাতেই পচিত। খাওয়া দাওয়ারও সুখ মনিব-মহলে দেখি নাই। কোন দিন ঝাল বেশী পড়িত—নুন কম পড়িত। কখনও তাঁহারা মাংস আধ কাঁচাই খাইতেন—কোন দিন বা বেশী পোড়া খাদ্যই তাঁহাদের কপালে জুটিত। অর্থব্যয় কম হইত না—সকল বিষয়েই অপব্যয় যৎপরোনাস্তি হইত। পূর্ব্বেই বলিয়াছি লক্ষ্মীশ্রী মনিব-মহল হইতে বিদায় লইয়াছিল।
ক্রমশঃ দেখা গেল যে, গোলামেরাই মনিবসমাজ অপেক্ষা বেশী সুখে আছে। যে সময়ে মনিবেরা বিলাসসাগরে ভাসিয়া অকর্ম্মণ্য ও নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছিলেন, সেই সময়ে গোলামেরা সকলেই কর্ম্মনিষ্ঠা, পরিশ্রম-স্বীকার, ইত্যাদি সদ্গুণ অর্জ্জন করিতেছিল। যখন তাহারা স্বাধীনতা পাইল তাহাদের পক্ষে নবজীবন আরম্ভ করিতে বিশেষ কোন কষ্ট হইল না। গোলামীর যুগের শিক্ষাই স্বাধীনতার যুগের কাজকর্ম্মের জন্য তাহাদিগকে প্রস্তুত করিয়া তুলিয়াছিল। কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যারই তাহাদের অভাব ছিল। তাহা ছাড়া অনেক বিষয়েই তাহাদের চরিত্র ও বুদ্ধি মার্জ্জিত হইয়াছিল। বিশেষতঃ তাহারা কোন না কোন কৃষিকর্ম্মে বা শিল্পকার্য্যে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু মনিব মহাশয়দের অবস্থা বড়ই শোচনীয় হইল। তাঁহারা গোলামদিগকে খাটাইতে খাটাইতে নিজেরাই সকল বিষয়ে যথার্থ গোলাম, পরমুখাপেক্ষী ও পরনির্ভর হইয়া পড়িয়াছিলেন।
দেখিতে দেখিতে লড়াই শেষ হইয়া গেল। আমরা মুক্তি পাইলাম। গোলামাবাদে মহা আনন্দের রোল উঠিল। আমরা যে স্বাধীন হইতে পারিব সংগ্রামের অবস্থা দেখিয়া ইতিপূর্ব্বেই অনুমান করিতে পারিয়াছিলাম। কারণ প্রায়ই দেখিতাম দক্ষিণপ্রান্তের মনিবেরা হারিয়া গৃহে ফিরিতেছেন— কেহ পলাইতেছেন—কেহ ঘরবাড়ী সামলাইবার ব্যবস্থা করিতেছেন। উত্তরপ্রান্তের ইয়াঙ্কি সৈন্যেরা দলে দলে গোলামাবাদগুলি দখল করিতে আসিবে—এইরূপ ভাবিয়া আমাদের প্রভুগণ টাকা-কড়ি মাটির মধ্যে পুঁতিয়া রাখিতে আরম্ভ করিলেন। আমরাই এই লুক্কায়িত ধনের পাহারায় নিযুক্ত হইলাম। আমরা ইয়াঙ্কি সৈন্যগণকে অন্ন বস্ত্র জল ইত্যাদি সকল জিনিসই দিতাম—কিন্তু সেই লুক্কায়িত ভাণ্ডার কাহাকেও দেখাই নাই। কারণ আমাদিগকে বিশ্বাস করিয়া প্রভুরা নিশ্চিন্ত হইয়াছেন।
যতই দিন অগ্রসর হইতে লাগিল আমরা গলা ছাড়িয়া গান সুরু করিলাম। আগে গুন্ গুন্ করিয়া গাহিতাম মাত্র। ক্রমশঃ আওয়াজ বাড়িল—সন্ধ্যার আমোদ গভীর রাত্রে শেষ হইতে লাগিল। স্বাধীনতা পাইবার পূর্ব্বেই অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করিতে লাগিলাম। এই আনন্দ-উৎসবের সময়ে আমরা স্বাধীনতার গানই গাহিতাম। পূর্ব্বেও আমরা অনেক সময়ে স্বাধীনতার গান গাহিয়াছি। কিন্তু তখন যদি কেহ স্বাধীনতার অর্থ জিজ্ঞাসা করিত আমরা তাহাকে বুঝাইয়া দিতাম যে তাহা পরলোকের স্বাধীনতা মাত্র— আত্মার মুক্তি মাত্র। এক্ষণে আমরা আর সেই আবরণ রাখিলাম না। এক্ষণে আমরা সোজাসুজি বলিতাম যে স্বাধীনতার অর্থ এই জগতেরই স্বাধীনতা—এই ভৌতিক শরীরেরই মুক্তি—অন্নবস্ত্র, চলা-ফেরা ইত্যাদি সকল বিষয়ের বন্ধনহীনতা।
সেই মহা আনন্দের দিনের পূর্ব্ব রাত্রে গোলামখানার মহলে মহলে সংবাদ পাঠান হইল “কাল সকালে প্রভুদের বড় কুঠিতে একটা বিশেষ সম্মিলন হইবে। তোমরা সকলেই উপস্থিত হইও।” সেই রাত্রে আমাদের আর ঘুম হইল না। সকালে উঠিয়াই আমরা প্রভুর গৃহে সমবেত হইলাম। দেখিলাম মনিব-পরিবারের সকলেই বারান্দায় দাঁড়াইয়া বা বসিয়া আছেন। সকলকেই যেন কিছু চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন দেখিলাম—কিন্তু কাহাকেও বিশেষ দুঃখিত বলিয়া বোধ হইল না। বরং মনে হইতে লাগিল যে তাঁহারা আর্থিক ক্ষতির জন্য বেশী চিন্তা করিতেছেন না—তাঁহারা যে এতদিনের সঙ্গী ও আত্মীয়গণকে একদিনে বিদায় দিবেন সেই দুঃখেই তাঁহাদের চিত্ত ভরিয়া রহিয়াছে। আর দেখিলাম একখন নূতন পুরুষকে, ইনি বোধ হয় যুক্তরাজ্যের কোন কর্ম্মচারী। তিনি একটা লম্বা কাগজ হাতে করিয়া একটা ক্ষুদ্র বক্তৃতা করিলেন। তার পর সেই কাগজ হইতে পাঠ করিলেন—স্বাধীনতার ঘোষণা।
পড়া শেষ হইয়া গেল, আমাদিগকে বলা হইল যে আমরা স্বাধীন হইয়াছি। যাহার যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারি। এখন হইতে যাহার যে কাজ ভাল লাগে সে সেই কাজই করিতে পারে। আমার মাতা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁহার চক্ষু হইতে আনন্দাশ্রু ঝরিতে লাগিল। তার পর তিনি বলিলেন যে, এই দিনের জন্যই তিনি এত কাল প্রার্থনা করিয়াছেন। তাঁহার বিশেষ দুঃখ এই ছিল যে, বোধ হয় তিনি এই সুখের দিন দেখিবার পূর্ব্বেই মারা যাইবেন।
কিয়ৎকাল সর্ব্বত্র নাচানাচি এবং ধন্যবাদের পালা পড়িল। আনন্দের আর সীমা নাই—বিকট উল্লাসে সকলেই যেন অধীর। কিন্তু প্রতিহিংসা বা মনিবদের প্রতি বিরুদ্ধতাচরণ করিবার প্রবৃত্তি কোথায়ও লক্ষ্য করি নাই।
আনন্দের ধ্বনি ক্রমশঃ মন্দ হইতে লাগিল। পরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত গোলাম মহলে চিন্তা আসিয়া জুটিল। স্বাধীন ত হইলাম। কিন্তু স্বাধীনতার দায়িত্ব ত বড় কম নয়? স্বাধীন ভাবে চলিতে ফিরিতে হইবে—স্বাধীন ভাবে অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করিতে হইবে। নিজে মাথা খাটাইয়া নিজ নিজ অভাব মোচন করিতে হইবে—নিজ বাহুবলে ও নিজ চরিত্রবলে গৃহস্থালী, পরিবার-পালন, সস্তানরক্ষা, সমাজ-ব্যবস্থা, ধর্ম্ম-কর্ম্ম সকলই চালাইতে হইবে। এ যে বিষম দায়িত্ব। দশ বৎসরের একটি বালককে যেন তাহার বাপ মা বলিলেন যে “বাছা তুমি নিজ শক্তিবলে যাহা পার কর—চরিয়া খাও—আমাদের কোন সাহায্য, পাইবে না!” আমাদের পক্ষেও ঠিক যেন এইরূপ আদেশ হইল। ইহা অনুগ্রহ কি নিগ্রহ ভুক্তভোগী ভিন্ন কে আর তাহা বুঝিবে?
সমগ্র য়্যাংগ্লো-স্যাক্সন জাতি হাজার বৎসরেও যে সকল সমস্যার মীমাংসা এখনও সুন্দররূপে করিয়া উঠিতে পারে নাই, নিগ্রোজাতির ঘাড়ে সেই সমস্যার সমাধান করিবার ভার হঠাৎ চাপাইয়া দেওয়া হইল! কাজেই দেখিতে দেখিতে স্বাধীনতালাভের আনন্দ গোলামাবাদের মহলে মহলে গভীর দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগে পরিণত হইবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? যে স্বাধীনতারত্নের জন্য তাহারা অনেকে এতদিন অশ্রু ফেলিয়াছে, আজ যখন তাহা সত্য সত্যই তাহাদের করতলগত হইল, তখন যেন তাহারা ভাবিতে লাগিল—“ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।” অনেকের বয়স প্রায় ৭০/৮০ বৎসর। তাহারা নূতন করিয়া জীবন আরম্ভ করিতে সম্পূর্ণ অপারগ। ইহাদের পক্ষেই কষ্ট সর্ব্বাপেক্ষা বেশী। অধিকন্তু, তাহারা এত কাল মনিবদের সেবা করিয়া তাঁহাদের প্রতি সত্য সত্যই অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিল— তাঁহাদের সঙ্গে আত্মীয়তার নিবিড় বন্ধন জন্মিয়াছিল। তাঁহারা যে ইহাদের আপন হইতেও আপন। তাঁহাদের পারিবারিক সুখে ইহারা যে কতই না সুখ অনুভব করিয়াছে এবং দুঃখে কতই না কষ্ট ভোগ করিয়াছে। যাঁহাদের সঙ্গে বসবাস করিয়া অর্দ্ধ শতাব্দী কাটিয়াছে, তাঁহাদের মায়া যে কোন মতেই ছাড়ে না। সমস্ত গোলামাবাদের আব্হাওয়াতেই তাহাদের জীবন পুষ্ট হইয়াছে। তাহাদের হৃদয়ের শিকড়গুলি প্রভুর পুত্র-কন্যায় এবং মনিবের সম্পত্তিতে দৃঢ়ভাবেই প্রবেশ করিয়াছে। সেই হৃদয়ের সম্বন্ধ একদিনে ছিঁড়িয়া ফেলা কি সম্ভবপর? সেই প্রেমের বন্ধন ছিন্ন করিলে কি তাহারা বাঁচিতে পারে?
- ↑ আমেরিকার শিক্ষাপ্রচারক বুকার ওয়াসিংটনের “আত্মজীবন-চরিত” গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ।