বিষয়বস্তুতে চলুন

নিগ্রোজাতির কর্ম্মবীর (১৯১৪)/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়

আমার বাল্য-জীবন

 স্বাধীনতা লাভের পর দক্ষিণ প্রান্তের গোলামেরা তাহাদের কর্ত্তব্য স্থির করিতে লাগিল। প্রথম সাব্যস্থ হইল যে তাহাদের নামগুলি পরিবর্ত্তন করা আবশ্যক। গোলামী যুগের নাম রাখা আর কোন মতেই যুক্তি সঙ্গত নয়। আর একটা প্রস্তাবেও সকলেরই যথেষ্ট আগ্রহ দেখা গেল। তাহারা স্থির করিল যে কিছু দিনের জন্য গোলামাবাদের বাহিরে যাইয়া তাহাদের বাস করা আবশ্যক। তাহা হইলেই তাহারা সত্য সত্য স্বাধীন হইয়াছে কিনা সহজে বুঝিতে পারা যাইবে। বিশষতঃ গোলামখানার গণ্ডীর বাহিরে যাইতে পারাটাই তাহাদের নব প্রাপ্ত স্বাধীনতার প্রথম লক্ষণ বিবেচিত হইবে।

 গোলামীর যুগে দাসগণের নামগুলিও গোলামীসূচক ছিল। তাহাদের নামের আগে পিছে কোন পদরী বা সম্মান বা জাতি বা ব্যবসায় বা ধর্ম্মবাচক কোন শব্দ সংযুক্ত থাকিত না। একটি মাত্র শব্দেই তাহাদের নাম প্রকাশিত হইত। কেহ ‘জন,’ কেহ বা ‘সুসান,’ কেহ ‘হরা,’ কেহ বা ‘পদা,’ ইত্যাদি। বড় জোর প্রভুর উপাধি বা পদবী এই সকল নামের সঙ্গে সংযুক্ত হইত। প্রভুর পদবী ‘হ্যাবরে’ থাকিলে, তাঁহার দাসেরা ‘হ্যাবারের জন’ বা ‘জন হ্যাবার’ ইত্যাদি নামে অভিহিত হইত। ‘জন’ ত হ্যাবারের সম্পত্তি বিশেষ। হ্যাবারের কুকুর বলিলে কুকুরে হ্যাবারে যেরূপ সম্বন্ধ বুঝায় এবং কুকুরকে যেরূপ সহজে চিনিয়া লওয়া যায়, ‘হ্যাবারের সুসান’ এই নামেও সুসানের সঙ্গে হ্যাবারের সেইরূপ সম্বন্ধই বুঝাইত এবং সেইরূপ সহজেই দাস মহল হইতে সুসান গোলামকে চিনিয়া লওয়া যাইত। বলা বাহুল্য এরূপ নামকরণে স্বাধীনতার গন্ধ মাত্র নাই—ব্যক্তি একটি নির্জ্জীব পদার্থ স্বরূপ, কেনা গোলাম মাত্র। প্রভু যেন তাহার কপালে একটা দাগ দিয়া নিজ সম্পত্তির হিসাব ও চিহ্ন রাখিয়াছেন মাত্র।

 সুতরাং পুরাতন নাম বর্জ্জন এবং নূতন নাম গ্রহণই স্বাধীন নিগ্রোর সর্ব্ব প্রধান কর্ত্তব্য নির্দ্ধারিত হইল। প্রভুদের নাম নিজ নিজ নাম হইতে তুলিয়া দেওয়া হইল। তাহার পরিবর্ত্তে কেহ ‘জন এস্‌লিঙ্কল্‌ন’ কেহ ‘জন এস্ শার্ম্মান’ ইত্যাদি নাম গ্রহণ করিতে লাগিল। মধ্যস্থলের ‘এস্’ শব্দের কোন অর্থই থাকিত না। তিন শব্দের নাম রাখিতেই হইবে—সুতরাং প্রথম শব্দে প্রকৃত নাম, তৃতীয় শব্দে উপাধি বা পদবী, দ্বিতীয় শব্দে যা হয় কিছু বুঝান হইত।

 তাহার পর গোলামাবাদ ছাড়িয়া সকলেই কিছু দিনের জন্য এদিক ওদিক ঘুরিতে ফিরিতে লাগিল। পরে কেহ কেহ ফিরিয়া জাসিয়া পুরাতন মনিবের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কারবার করিবার জন্য নূতন নূতন চুক্তি বা বন্দোবস্ত করিয়া লইল। বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করা কঠিন। যাহারা এইরূপে পুরাতন মনিবের সঙ্গেই বসতি করিতে চাহিল, তাহাদের মধ্যে বৃদ্ধদের সংখ্যাই বেশী।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি আমি আমার জনককে কখনও দেখি নাই। আমার মাতার দ্বিতীয় পক্ষের স্বামী ছিলেন। তাঁহাকেও বড় বেশী দেখি নাই। আমরা যে মনিবের গোলাম ছিলাম তিনি সেই মনিবেরই গোলাম ছিলেন না। তাঁহার গোলামীর কর্ম্মক্ষেত্র কিছু দূরে ছিল। স্বাধীনতা পাইবার পূর্ব্বেই তিনি পলাইয়া একটা নবগঠিত প্রদেশে আশ্রয় লইয়াছিলেন। প্রদেশের নাম ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়া। সেই সময়ে লড়াই চলিতেছিল—এজন্য তাঁহার পলায়নের বিশেষ বিঘ্ন ঘটে নাই। যখন সকল দাসেরই স্বাধীনতা ঘোষিত হইল, তিনি আমার মাতাকে আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নূতন বাসভবনে আসিতে আদেশ করিলেন। ভার্জ্জিনিয়া প্রদেশে যাইতে হইলে পার্ব্বত্য প্রদেশ পার হইয়া যাইতে হয়। দূরও বড় কম নয়—প্রায় ৭০০। ৮০০ মাইল। আমাদের জামা কাপড় ইত্যাদি কিছুই ছিল না। যাহা হউক গরুর গাড়ীতে চড়িয়া আমরা সকলে যাত্রা করিলাম। অবশ্য বেশী পথ হাঁটিয়াই চলিয়াছিলাম।

 আমরা পূর্ব্বে কোনদিনই এক প্রদেশ ছাড়িয়া অন্য প্রদেশে যাই নাই। এমন কি, গোলামাবাদ ছাড়িয়া বেশী দূর যাইবার অবসর বা কারণও কখন উপস্থিত হয় নাই। এইবার কাজেই আমাদের বিদেশযাত্রার সমারোহ মনে হইয়াছিল! পুরাতন মনিবগণের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। সে দৃশ্য অতিশয় হৃদয়বিদারক। সেই চির-বিদায়ের কথা সর্ব্বদা আমার মনে আছে। তাঁহাদের সঙ্গে এখন পর্য্যন্ত আমি চিঠি-পত্রের আলাপ রক্ষা করিয়া আসিয়াছি। এখনও তাঁহাদিগকে ভুলিতে পারি নাই।

 রাস্তায় কয়েক সপ্তাহ কাটিয়া গেল। খোলা মাঠে শুইতাম, গাছতলায় রাঁধিয়া খাইতাম। এক রাত্রে একটা পুরাতন ভাঙ্গাবাড়ী পাইয়া আমার মাতা তাহার মধ্যে রন্ধনের আয়োজন করিতে লাগিলেন। সেই বাড়ীতে একটা ‘ষ্টোভ’ ছিল। ষ্টোভের ভিতর আগুন জালিবা মাত্র উহার নলের ভিতর হইতে একটা প্রকাণ্ড কাল সাপ বাহির হইয়া আসিল। আমরা ‘ত্রাহি ত্রাহি’ ডাক ছাড়িয়া সেই গৃহে ভোজন-শয়নের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করিলাম। এইরূপে নানা সুখদুঃখের অভিজ্ঞতা লাভ করিতে করিতে আমাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছিলাম। নগরটি ক্ষুদ্র—নাম ম্যাল্‌ডেন। ইহার পাঁচ মাইল দূরেই ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়াপ্রদেশের রাজধানী বা প্রধান নগর চার্লষ্টন।

 এই সময়ে ওয়েষ্ট ভার্জ্জিনিয়ায় নুনের কারবার বেশ চলিতেছিল। আমাদের নগরের ভিতরেই এবং আশেপাশে অনেকগুলি নুনের কল ছিল। এইরূপ একটা কলে আমার মাতার স্বামী একটা চাকরী পাইয়াছিলেন। তাহার নিকটেই তিনি একটা কামরাও সংগ্রহ করিয়াছিলেন। এই কামরা আমাদের পুরাতন গোলামখানার কুঠুরী অপেক্ষা খারাপই হইবে, কোন অংশেই ভাল নয়। গোলামাবাদের কুঠুরিগুলি যেরূপই থাকুক না কেন, তাহার বাহিরে আসিলে নির্ম্মল বাতাস যথেষ্টই পাইতাম। কিন্তু এই স্বাধীন বাসভবনে ইহার অভাব যৎপরোনাস্তি। কামরাগুলি এত লাগালাগি এবং চারি ধারে এত ময়লা জমিয়া থাকে যে একটা প্রকাণ্ড নরকের মধ্যে আমরা বাস করিতেছি মনে হইত।

 আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে সাদা কাল দুই প্রকার লোকই ছিল। সাদা চামড়ার লোকেরা অবশ্য শ্বেতাঙ্গ-সম্প্রদায়ের অতি নিম্নশ্রেণীর অন্তর্গত। তাহাদের না ছিল বিদ্যাবুদ্ধি, না ছিল পরিচ্ছন্নতা, না ছিল ধর্ম্ম-ভয়। বরং অধর্ম্ম, অস্বাস্থ্য, অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার যেন সেই আবহাওয়ার মধ্যে অপ্রতিহতগতিতে বিরাজ করিত।

 পাড়ার প্রায় সকলেই নুনের কলে কাজ করিত। আমার বয়স অত্যন্ত অল্পই ছিল। তথাপি আমার মাতার স্বামী আমাকে একটা কাজে লাগাইয়া দিলেন। আমার দাদাও একটা কাজে লাগিয়া গেল। আমাকে প্রত্যূষে চারিটা হইতে কাজ করিতে হইত।

 এই নুনের কলে কাজ করিতে করিতে আমার প্রথম কেতাবীশিক্ষা লাভ হয়। নুন বস্তাবন্দি করিবার পর বস্তার গায়ে একটা করিয়া নম্বর বসাইবার নিয়ম ছিল। আমার অভিভাবকের চিহ্ন ছিল ১৮। প্রতিদিন কলের কাজ শেষ হইবার সময়ে কলের একজন বড় সাহেব আসিয়া আমার অভিভাবকের বস্তাগুলির উপর ১৮ এই চিহ্ন লিখিয়। যাইত। আমি আর কোন চিহ্ন চিনিতাম না। অনবরত দেখিতে দেখিতে ১৮ চিহ্নটি আমার সুপরিচিত হইয়া গেল।

 আমার প্রথম হইতেই লেখা পড়া শিখিবার বড় সাধ ছিল। শৈশবেই আমি সঙ্কল্প করিয়াছিলাম যে জীবনে যদি আর কিছুই না করিতে পারি অন্ততঃ যেন কিছু বিদ্যালাভ করিয়া মরিতে পারি। আর কখনও যদি আমি লেখাপড়া শিখি তাহা হইলে অন্ততঃ সাধারণ খবরের কাগজ এবং সাদাসিধা পুস্তকাবলী পড়িয়া বুঝিতে পারিলেই কৃতার্থ হইব। এখানে আসিবার পর আমার মাতাকে অনুরোধ করিয়া একখানা পুস্তক আনাইয়া লইলাম। ওয়েব্‌স্টারের ‘বর্ণ-পরিচয়’ বই আমার হস্তগত হইল। আমি অতি মনোযোগ সহকারে পড়িতে লাগিলাম। কোন শিক্ষকেরই সাহায্য পাই নাই। যাহা হউক, যেন তেন প্রকারেণ অক্ষরগুলি চিনিয়া ফেলিলাম। আমার মাতাই আমার এই প্রাথমিক শিক্ষালাভের চেষ্টায় একমাত্র সহায় ছিলেন। তাঁহার পুঁথিগত বিদ্যা কিছুই ছিল না সত্য—কিন্তু তাঁহার সাংসারিক জ্ঞান, অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা করিবার ক্ষমতা, সৎসাহস, দৃঢ় সঙ্কল্প, উন্নতির আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি অশেষ গুণ ছিল। কাজেই আমার উচ্চ অভিলাষে তিনি যথেষ্টই সাহায্য করিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার নিকট উৎসাহ না পাইলে আমার জীবনের গতি হয়ত অন্যরূপ হইত।

 ইতিমধ্যে একটি নিগ্রো বালক ম্যাল্‌ডেনে আসিল। সে ওহায়ো প্রদেশের কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখিত। তাহাকে পাইয়া আমার নিগ্রো স্বজাতিরা যেন চাঁদ হাতে পাইল। তাহার আদর দেখে কে? প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে কাজ-কর্ম্ম সারিয়া আমাদের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে মিলিয়া তাহাকে ঘিরিয়া বসিতাম। সে একটা খবরের কাগজ পড়িয়া আমাদিগকে শুনাইত ও বুঝাইয়া দিত। সে আমাদের পাড়ার গুরু মহাশয় হইয়া পড়িল। তাহার এই সম্মান ও ক্ষমতা দেখিয়া আমি সত্যসত্যই তাহাকে হিংসা করিতাম। মনে হইত তাহার সমান বিদ্যার অধিকারী হইতে পারিলে আমি আর কিছু চাহি না।

 ক্রমশঃ আমাদের পল্লীতে নিগ্রোদের জন্য একটা পাঠশালা খুলিবার প্রস্তাব চলিতে লাগিল। মহা ধূমধাম আরম্ভ হইল। কৃষ্ণকায়-সমাজে একটা বিদ্যালয়ের কথা এ অঞ্চলে আর পূর্ব্বে কখনও উঠে নাই। সর্ব্বত্রই আন্দোলন পৌঁছিল। প্রধান সমস্যা হইল—শিক্ষক পাওয়া যায় কোথায়? ওহায়োর সেই বালকের নামই সকলের মুখে মুখে রহিয়াছে। কিন্তু সে যে নিতান্তই চ্যাংড়া। যাহা হউক, ওহায়ো হইতে আর একজন শিক্ষিত যুবক ম্যাল্‌ডেন নগরে হঠাৎ আসিয়া দেখা দিল। তাহার বয়স সম্বন্ধে কোন আপত্তি হইল না। সে কিছুকাল সেনাবিভাগেও কাজ করিয়াছে। সুতরাং তাহাকেই শিক্ষকপদে নিযুক্ত করা হইল।

 পাঠশালার খরচ চালাইবার জন্য নিগ্রোরা সকলেই মাসিক কিছু কিছু চাঁদা দিতে স্বীকৃত হইল। শিক্ষকের বেতন জোগান কঠিন। কাজেই বন্দোবস্ত হইল যে, সে প্রত্যেক পরিবারে একদিন করিয়া শয়ন ভোজন করিবে। এইরূপে চাঁদা করিয়া খাওয়ানব্যবস্থা শিক্ষকের পক্ষে মন্দ নয়। কারণ যেদিন যে পরিবারের পালা সেদিন তাহারা শিক্ষককে যথাসম্ভব ‘চর্ব্য চোষ্য লেহ্য পেয়’ না দিয়া থাকিতে পারে কি? আমার মনে আছে—আমি আমাদের পরিবারের সেই ‘মাষ্টারের দিন’ কবে আসিবে ভাবিয়া সুখী হইতাম। সেই দিন ফাঁকতালে আমারও বেশ ভাল খাদ্যই জুটিত!

 এই প্রণালীতে আর কোথায়ও বিদ্যালয় হইয়াছে কি? আমি জানি না। সমস্ত জাতিটাই যেন একটা পাঠশালা—সমস্ত গ্রামটাই যেন বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ—পাড়ার সকল লোকই যেন বিদ্যালয়ের ছাত্র, অভিভাবক, পরিচালক। সমগ্র জাতির পক্ষে বিদ্যারম্ভ ও “হাতে খড়ী” হইল। এই উপায়ে আর কোন জাতি জগতের ইতিহাসে গড়িয়া উঠিয়াছে কি?

 নিগ্রো-সমাজের কেহই এই শিক্ষার আন্দোলনে যোগদান করিতে পশ্চাৎপদ রহিল না। বৃদ্ধ, বালক, যুবা সকলেই আগ্রহের সহিত লেখাপড়া শিখিতে লাগিল। “মরিবার পূর্ব্বে যেন অন্ততঃ বাইবেল-গ্রন্থ পড়িতে পারি”—এই আকাঙ্ক্ষায় আশী বৎসরের বৃদ্ধ লোকেরাও বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইল। কোনরূপে শিক্ষক পাইলেই পাঠশালা খোলা হইত। দিবাবিদ্যালয়, নৈশবিদ্যালয়, রবিবারের বিদ্যালয় ইত্যাদি নানাবিধ পাঠশালার সাহায্যে নিগ্রোপল্লীতে বর্ণ-জ্ঞান, বানান, সরল ধর্ম্ম-ব্যাখ্যা ইত্যাদি প্রচারিত হইতে লাগিল।

 যাহা হউক, আমাদের জাতীয় বিদ্যালয় ত প্রতিষ্ঠিত হইল। কিন্তু আমার কপাল ফিরিল না। আমি বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইতে পাইলাম না। আমার অভিভাবক আমাকে নুনের কলে খাটাইয়া অর্থ সঞ্চয় করিতে লাগিলেন। বড়ই অনুতাপের বিষয় হইত যখন আমি কল হইতে দেখিতাম যে, আমারই সমানবয়স্ক নিগ্রোবালকেরা সকালে সন্ধ্যায় স্কুলে যাওয়া আসা করিতেছে। অবশ্য আশা ছাড়িলাম না। আমি আমার সেই ওয়েব্‌ষ্টারের ‘প্রথম ভাগ’ই পূর্বের ন্যায় পড়িতে থাকিলাম।

 পরে পাঠশালার গুরুমহাশয়ের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ত করিয়া লইলাম। রাত্রে যাইয়া তাঁহার নিকটে কিছু কিছু শিখিয়া আসিতাম—এই উপায়েই আমি অনেকটা শিখিয়া ফেলিলাম। আমি নৈশবিদ্যালয়ের উপকারিতা নিজ জীবনে যেরূপ উপলব্ধি করিয়াছি আর কেহ তাহা বোধ হয় করেন নাই। এইজন্য আমি আজকাল নৈশবিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠার এত পক্ষপাতী। এই অভিজ্ঞতার সাহসেই আমি পরে হ্যাম্পটনে এবং টাস্কেজীতে নৈশবিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছি।

 কিন্তু কেবলমাত্র নৈশবিদ্যালয়ের শিক্ষা পাইয়াই আমি কোন মতে স্থির থাকিতে পারিলাম না। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলাম—দিবাভাগের বিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হইবই হইব। কান্নাকাটি করিতে করিতে অভিভাবকের অনুমতি পাইলাম। স্থির হইল যে, আমি খুব সকালে ঘুম হইতে উঠিয়াই নয়টা পর্য্যন্ত কলে কাজ করিব। পরে বিদ্যালয়ে যাইব এবং বিদ্যালয়ের ছুটির পরেই আরও দুই ঘণ্টা কলে কাজ করিব।

 আমি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। কিন্তু বড় কঠিন ব্যাপার। পাঠশালা নয়টার সময়েই বসে অথচ আমার বাড়ী হইতে ইহার দূরত্বও কম নয়। কাজেই নয়টা পর্য্যন্ত কলে কাজ করিয়া স্কুলে পৌঁছিতে রোজই আমার দেরী হইতে লাগিল। এ অসুবিধা এড়াইবার জন্য আমি একটা ফিকির করিলাম। আপনারা আমার দুষ্টামী দেখিয়া চটিবেন। কিন্তু কি করিব? সত্য কথা বলিতেছি। আমাকে বাধ্য হইয়াই অসত্যের পথ ধরিতে হইয়াছিল। কলের আফিসে একটা ঘড়ি ছিল। সেই ঘড়ি দেখিয়া সকলে কাজ-কর্ম্মের সময় ঠিক করিত। আমি রোজ সকালে যাইয়া সেই ঘড়ির কাঁটা সরাইয়া দিতাম। ঠিক ৮॥০ সময়ে ৯টা বাজিয়া যাইত। আমি কল ছাড়িয়া যথাসময়ে পাঠশালায় পৌঁছিতাম। পরে বড় সাহেব ব্যাপার বুঝিয়া অফিস ঘরে চাবি লাগাইয়া দিলেন। আমি আর ঘড়ির কাঁটা সরাইতে পারিতাম না।

 পাঠশালায় ত ভর্ত্তি হইলাম। হইয়াই বিপদ। সকল ছাত্রের মাথায়ই একটা করিয়া টুপি। কিন্তু আমার মাথায় কোন আবরণই ছিল না। মাথার টুপি দিবার প্রয়োজন আছে কি না তাহা অবশ্য আমি পূর্ব্বে কখনও চিন্তা করিতেই পারি নাই। পাঠশালায় যাইবামাত্রই আমার অভাব বুঝিতে পারিলাম। তখন আমাদের অঞ্চলে নূতন ফ্যাশনের এক টুপি উঠিয়াছে। ছেলে বুড়ো সকলেই সেই টুপি ব্যবহার করে। আমার মাতার অত পয়সা নাই। তিনি দুই টুকরা কাপড় দিয়া ঘরেই একটা টুপি শেলাই করিয়া দিলেন। আমি টুপি মাথায় দিলাম!

 আমি এই ঘটনায় একটা বড় শিক্ষা পাইয়াছিলাম। তাহা আমি চিরজীবন কাজে লাগাইতে চেষ্টা করিয়াছি। আমার মাতা কখনও লোক-দেখান বাবুগিরি বা সামাজিকতা অথবা লৌকিকতার ধার ধারিতেন না। সর্ব্বদাই নিজের আর্থিক অবস্থানুসারে তিনি গৃহস্থালী চালাইতেন। অন্যান্য অনেক নিগ্রোকে দেখিয়াছি—যাহাদের পেটে অন্ন জুটে না—কিন্তু নূতন ফ্যাশনের টুপি মাথায় দিয়া বেড়াইতে না পারিলে ঘুম হয় না! এজন্য তাহারা ঋণগ্রস্ত পর্য্যন্ত হইয়া থাকে। আমার মাতার সৎসাহস দেখিয়া মোহিত হইয়াছিলাম। তিনি ধার করিয়া বাবুগিরি ও ফ্যাশনের দাস হইলেন না। তৎকালীন নিগ্রোসমাজের পক্ষে এরূপ চরিত্রবত্তা নিতান্তই বিরল। আজ অতীতের ঘটনাবলী স্মরণ করিয়া বুঝিতে পারিতেছি যে আমার সমপাঠীদের ভিতর যাহারা বাবুগিরি ও বিলাসের নূতন নূতন অনুষ্ঠানগুলি ব্যবহার করিত তাহারা পরে অনাহারে দুঃখে দারিদ্র্যে জীবন কাটাইয়াছে।

 পাঠশালায় ভর্ত্তি হইবার সময়ে আমাকে আর একটা বিপদ উত্তীর্ণ হইতে হইয়াছিল। এতদিন আমাকে লোকে ‘বুকার’ বলিয়া ডাকিত। তাহাই আমার নাম জানিতাম। স্কুলে যইবা মাত্রই নাম লইয়া মহা গোলযোগে পড়িলাম। প্রত্যেক ছাত্রেরই দুইটা শব্দে নাম ডাকা হইতেছে। কাহারও বা তিন শব্দে নাম সম্পূর্ণ। আমার মাথা ঘুরিতে লাগিল। শিক্ষক মহাশয় যখন আমার নাম খাতায় তুলিবেন তখন কি বলিব? ভাবিতে ভাবিতে একটা ঠিক করিয়া লইলাম। যেই শিক্ষক আমার গোটানাম শুনিতে চাহিলেন, আমি গম্ভীর স্বরে বলিয়া দিলাম ‘বুকার ওয়াশিংটন’ যেন চিরদিন আমাকে লোকে এই নামেই জানে। পরে শুনিয়াছি, আমার মাতা আমাকে ‘বুকার ট্যালিয়াফারো’ নাম দিয়াছিলেন। কিন্তু ‘ট্যালিয়াফারো’ শব্দ কোন কারণে আমার মনে ছিল না। যখন ইহা জানিলাম তখন হইতে আমি তিন তিনটা শব্দের নাম ব্যবহার করিয়া আসিতেছি। সুতরাং আজ আমি বুকার ট্যালিয়াফারো ওয়াশিংটন।

 অনেক সময়ে আমি নিজকে কোন বড় লোকের সন্তানরূপে কল্পনা করিতে চেষ্টা করিয়াছি। যেন আমার পূর্ব্বপুরুষেরা ধনীসচ্চরিত্র, সুপণ্ডিত ইত্যাদি ছিলেন। যেন উত্তরাধিকারের সূত্রে আমি বংশ গৌরব, সামাজিক কীর্ত্তি, জমিদারী ইত্যাদির অধিকারী হইয়া জন্মিয়াছি। যেন আমি একটি বনিয়াদি ঘরের সন্তান। কিন্তু এইরূপ কল্পনায় আমি বিশেষ সুখী হইতাম না। আমি বুঝি, পূর্ব্বপুরুষের গৌরবের দোহাই দিয়া যদি আমি বড় হইতে যাই তাহা হইলে আমার নিজের কৃতিত্ব কি হইল? পরের ঘাড়ে চড়িলে সকলকেই বড় দেখায়। নিজ ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রভাব তাহাতে কিছু বুঝা যায় কি? তাহা ছাড়া উন্নতির পথে একটা বড় অসুবিধা বোধ হয় আসিয়া জুটে। সকল বিষয়ে পরের উপর নির্ভর করিবার প্রবৃত্তি জন্মে, পরের ধনে পোদ্দারি করিতে ইচ্ছা হয়। নিজে খাটিয়া নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করিতে সুযোগ বেশী পাওয়া যায় না। নিজের দায়িত্বজ্ঞান এবং কর্ত্তব্যবোধও কমিতে থাকে।

 এই সঙ্গে আর একটা কথা বলিয়া রাখি। নিগ্রোদের পূর্ব্বগৌরব কিছুই নাই। অতীত ইতিহাসের নজির আনিয়া তাহাদের কীর্ত্তিকলাপ প্রচার করিবার কোন উপায় নাই। এমন কি, তাহাদের অতীত নাই বলিলেই চলে—যাহা আছে তাহা অন্ধকারময়, হয়ত ঘৃণ্য, নিন্দনীয়। কিন্তু তাহা বলিয়া আপনারা তাহাকে অবজ্ঞা করিতে পারেন না—তাহাদের বর্ত্তমান কার্য্যকলাপ বিচার করিতে যাইয়া নাসিকা কুঞ্চিত করিবেন না। তাহারা জাতীয় জীবন আরম্ভ করিতেছে মাত্র, সমগ্র নিগ্রোজাতির এখন শৈশব অবস্থা। কাজেই তাহাদের বিঘ্ন অনেক, অসুবিধা অনেক, অকৃতকার্য্যতার কারণ অনেক। আপনারা বহুদিন হইতে জীবন আরম্ভ করিয়াছেন, আপনারা প্রারম্ভিক যুগের নৈরাশ্য, অকৃতকার্য্যতা ইত্যাদি অতিক্রম করিয়া সফলতার পথে অনেকটা অগ্রসর হইয়াছেন। কিন্তু আমাদের এখন ‘হাতে খড়ী’র অবস্থা। আপনাদের আজকালকার কাজ-কর্ম্ম দেখিবার পূর্ব্বে সকলে ধরিয়া রাখে যে আপনারা কৃতকার্য্য হইবেন। কিন্তু আমরা কাজ আরম্ভ করিলে লোকেরা ভাবিয়া থাকে যে আমাদের অকৃতকার্য্যতাই সুনিশ্চিত। আমাদের সফলতা ‘হাতের পাঁচ’ স্বরূপ। কারণ আর কিছুই না—পৃথিবীর কর্ম্মক্ষেত্রে আপনারা প্রবীণ, আমরা নবীন, আপনাদের এখন জীবন-মধ্যাহ্ণের যুগ চলিতেছে, আমাদের জীবন-প্রভাতও বোধ হয় আরব্ধ হয় নাই।

 সুতরাং অতীত ইতিহাসের সুবিধাও আছে। পূর্ব্বপুরুষগণের চরিত্র-সম্বল বর্ত্তমান কালে ব্যক্তির ও জাতির মূলধন স্বরূপ কার্য্য করে। অতীতের স্মৃতি মানুষকে বর্ত্তমানে কর্ত্তব্য দেখাইয়া দেয়, ভবিষ্যতের জন্য দায়িত্ব শিখাইয়া দেয়। আর বাপ দাদার দোহাই অত্যধিক না দিলেই আত্মসম্মান-বোধ বজায় থাকে। পূর্ব্বকীর্ত্তি খানিকটা মনে রাখিয়া চলিলেই বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। আজকাল আপনারা কথায় কথায় শ্বেতাঙ্গ বালকবালিকা এবং নিগ্রো বালকবালিকার চরিত্র তুলনা করিয়া আমাদিগকে অবনত সপ্রমাণ করিয়া থাকেন। আমরা অনেক বিষয়ে যে হীন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু একবার আপনারা কল্পনা করিয়া দেখিবেন যে আপনাদের কোন পিতামহ মাতামহ ইত্যাদি ছিল না, আপনাদের বংশকথা নাই, আপনাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বাস্তুভিটা ইত্যাদি কিছুই নাই। তাহা হইলে আমাদের নৈতিক চরিত্রের অবস্থা বুঝিতে পারিবেন।

 যাহাদের আত্মীয়-স্বজন কেহ নাই, তাহাদের কি চরিত্র গঠিত হইতে পারে? যাহাদের পারিবারিক বন্ধন কিছু নাই, তাহারা কি চক্ষুলজ্জার ভয় করে? তাহাদের সমাজই যে নাই! যাহারা পূর্ব্বপুরুষদের কথা ভাবিতে শিখে নাই, যাহারা বর্ত্তমানে রক্তের সম্পর্ক স্বীকার করে না, যাহাদের মামা খুড়ী দিদি শ্বশুর ইত্যাদি সম্পর্কবিশিষ্ট গুরুজন নাই, যাহাদের সন্তানসন্ততির জন্য মায়া বিকশিত হইতে পারে না, তাহারা কি মানুষের ধর্ম্ম, মানুষের বিবেক, মানুষের সদসদ্‌জ্ঞান, ইত্যাদি অর্জ্জন করিতে পারে? নিগ্রোজাতির এই অবস্থা। সমাজের বা আত্মীয়গণের মুখ চাহিয়া তাহাদিগকে কোন কাজ করিতে হয় না। কাহারও গৌরব নষ্ট হইয়া গেলে সমাজে পরিবারের কলঙ্ক রটিবে, সে ভয় তাহাদের নাই। নিজে কোন কীর্ত্তির কর্ম্ম করিয়া গেলে পরিবারের দশজন এবং ভবিষ্যৎ বংশধরেরা তাহা লইয়া গৌরব করিবে—কোন নিগ্রোই এইরূপ ভাবিতে শিখে না।

 আমার কথা বলিলেই সকলে বিষয়টা বুঝিতে পারিবেন। আমার মাতামহী কে ছিলেন কখনও জানি না। আমি শুনিয়াছি আমার মামা মামী, পিসা পিসী, কাকা কাকী এবং মাস্‌তুত পিসতুত খুড়তুত ভাইবোন ইত্যাদি আছেন। কিন্তু তাঁহারা কে কোথায় কি করিতেছেন কিছুই জানি না। আমাদের নিগ্রোজাতির সকলেরই পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা এইরূপ। কিন্তু শ্বেতকায়দিগের কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রতিপদবিক্ষেপেই তাহাদিগকে পশ্চাতে ফিরিয়া তাকাইতে হয়। তাহারা যদি একটা অন্যায় কার্য্য করিয়া ফেলে, তাহা হইলে তাহার চৌদ্দপুরুষের মুখে চুণ-কালি পড়িবে। এই জ্ঞান তাহাদের সর্ব্বদা থাকে। কাজেই প্রলোভন, অসংযম ইত্যাদি তাহারা সহজে কাটাইয়া উঠিতে পারে। যখনই কোন শ্বেতকায় ব্যক্তি কর্ম্ম আরম্ভ করে, তখনই তাহার মনে বিরাজ করিতে থাকে যে, তাহার পূর্ব্বপুরুষেরা নানা সৎকর্ম্ম করিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন, সুতরাং সেও যে সিদ্ধিলাভ করিবে তাহা ত সুনিশ্চিত। পূর্ব্বপুরুষদের কৃতকার্য্যতা বর্ত্তমান প্রয়াসের একটা মস্ত সহায়।

 আমার অভিভাবক বেশী দিন আমাকে পাঠশালায় যাইতে দিলেন না। কিছুকাল পরেই আমার নাম কাটা হইয়া গেল। তখন হইতে আমি আবার সেই নৈশ-বিদ্যালয়ের শিক্ষাকেই জীবনের সম্বল করিলাম। আমার বাল্য-জীবনের সকল শিক্ষাই আমি নৈশ-বিদ্যালয়ে লাভ করিয়াছি—এ কথা বলিলে কোন অত্যুক্তি হইবে না। দিবাভাগে আমি লিখিবার পড়িবার অবসর কিছুমাত্র পাই নাই বলিলেই চলে।

 অনেক সময়ে কার্য্য শেষ করিয়া নৈশশিক্ষার চেষ্টায় রত হইয়া দেখিতাম—শিক্ষক নাই। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে আমাকে খুব ভুগিতে হইয়াছে। অনেক শিক্ষক এমন জুটিয়াছেন যাঁহাদের বিদ্যা প্রায় আমারই সমান! বহুকাল এরূপও কাটিয়াছে যখন রাত্রিকালে শিক্ষালাভের জন্য ৫।৬ মাইল দূরে হাঁটিয়া যাইতাম। আমার বাল্যজীবনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিল—যেমন করিয়াই হউক আমি শিক্ষালাভ করিব। এই জন্য নৈরাশ্য আমাকে কখনও আক্রমণ করিতে পারে নাই।

 ওয়েষ্ট-ভার্জ্জিনিয়ায় বসতি করিবার সময়ে আমার মাতা একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশুকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিলেন। “নিজে শুতে ঠাঁই পায় না—শঙ্করাকে ডাকে!” আমাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়—অথচ একজন নূতন লোক পরিবারে প্রবেশ করিল। আমরা তাহাকে ভাইএর ন্যায় গ্রহণ করিলাম। তাহার নাম দিলাম জেম্‌স্‌ বি ওয়াশিংটন।

 নুনের কলের কাজ ছাড়িয়া একটা কয়লার খনিতে কাজে নিযুক্ত হইলাম! এই খনি হইতে কলের কয়লা জোগান হইত। কয়লার খনিতে কাজ করিলে স্বাস্থ্য একেবারে নষ্ট হইয়া যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কাহাকে বলে তাহা জানা যায় না। সমস্ত দিন খাটিতে খাটিতে শরীরে এত ময়লা আসিয়া জমে যে তাহা আর উঠে না। এইজন্য আমি এই কাজে বিশেষ নারাজ ছিলাম। তাহার উপর, খনির মুখ হইতে কয়লার স্তর পর্য্যন্ত এক মাইল দূর। সেই রাস্তায় অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়া চলিয়া গেলে তবে কয়লার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সেই খানে আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়লার কামরা বা পাড়া। সেইগুলিকে অন্ধকারের মধ্যে চিনিয়া বাহির করা বড় সোজা কথা নয়। সেখানকার উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব্ব-পশ্চিম আমি কিছুই বুঝিতে পারিতাম না। কয়লার কামরাগুলিও আমি কোন দিনই খুঁজিয়া লইতে পারি নাই। অধিকন্তু হঠাৎ যদি লণ্ঠনের আলো নিবিয়া যাইত, তাহা হইলে “ছিদ্রেষ্বনর্থা বহুলীভবন্তি” হইত। এদিক ওদিক অন্ধের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম—দৈবাৎ অন্য কোন কুলীর দেখা পাইয়া পথ বাছিয়া লইতাম। মৃত্যুভয়ও কম ছিল না। খনির ভিতর দুর্দ্দৈব প্রায়ই ঘটিত। কোন সময়ে একচাপ কয়লা ধসিয়া পড়িয়া অসংখ্য লোকের মৃত্যুর কারণ হইত। কখনও বা বারুদ যথাসময়ের পূর্ব্বে ফাটিত। তাহাতে অসতর্ক কুলীরা মারা যাইত।

 ছেলেবেলায় যখন আমি নুনের কলে অথবা কয়লার খাদে কাজ করিতাম, তখন আমি শ্বেতাঙ্গ বালকদের মনের অবস্থা এবং হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা কল্পনা করিতে চেষ্টা করিতাম। যৌবনকালেও অনেকবার শ্বেতাঙ্গ যুবকদের অন্তরের চিন্তারাশি অনুমান করিতে চেষ্টা করিয়াছি। ভাবিতাম তাহাদের উচ্চ অভিলাষকে বাধা দিবার কিছুই নাই—সংসারের সকল পদার্থ ই তাহাদিগকে বড় বড় কর্ম্মের দিকে উৎসাহিত করিতেছে। ভাবিতাম তাহারা অনন্ত প্রেম, অনন্ত কর্ম্ম, অনন্ত জ্ঞান লইয়া নাড়াচাড়া করিবার সুযোগ পায়। কোন বিষয়ে ক্ষুদ্রত্ব, পঙ্গুত্ব, নীচত্ব তাহাদিগের চিন্তা ও কর্ম্মরাশিকে স্পর্শ করিতে পারে না। বড় বড় কারবার লইয়াই তাহারা ব্যাপৃত। তাহারা চেষ্টা করিলে যুক্তরাজ্যের সভাপতি হইতে পারিতেছে—বড় বড় অনুষ্ঠানের প্রবর্ত্তক হইতেছে—বিশাল কর্ম্মকেন্দ্রের পরিচালক হইতেছে। তাহারা ধর্ম্মমন্দিরের গুরুর পদে অধিষ্ঠিত হইতে পারে, দেশশাসকের মর্য্যাদা পাইতে পারে। কেহই তাহাদিগের উদ্যম আকাঙ্ক্ষা ও আশার সম্মুখে একটা সীমা-রেখা টানিয়া দিয়া হৃদয় ভাঙ্গিয়া দিতে পারে না। আমি ভাবিতাম যদি আমার এই সকল সুযোগ থাকিত তাহা হইলে আমি সামান্য পল্লীর নগণ্য কুটিরে জন্মিয়াও ক্রমে ক্রমে সহরের নেতা, জেলার কর্ত্তা, প্রদেশের নায়ক, সাম্রাজ্যের শাসনকর্ত্তার পদে উন্নীত হইতাম। হায় আমি নিগ্রো—এই কল্পনা আমার পক্ষে উন্মত্তের প্রলাপ, মরুভূমির মরীচিকা।

 ও সব বাল্যজীবন ও যৌবনের মনোভাব। আজ কিন্তু সত্য বলিতেছি—আমার ওরূপ কল্পনা বা আকাঙ্ক্ষা হয় না। আমি শ্বেতাঙ্গ মানবের সঙ্গে ঠিক ঐরূপ তুলনা করিয়া নিজের অবস্থা বুঝিতে চেষ্টা করি না। আমি শ্বেতাঙ্গ মানবের সুযোগ সুবিধা সাহায্যগুলি আদৌ হিংসা করি না। আজ প্রৌঢ় অবস্থায় আমি অতীতের ঘটনাবলী পর্য্যবেক্ষণ করিয়া বুঝিতেছি, মান, মর্য্যাদা, কীর্ত্তি, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি মনুষ্যত্বের সত্য মাপকাঠি নয়। কোন লোক জগতে বিখ্যাত হইলেই সে কৃতকার্য্যতা লাভ করিল, আমি তাহা স্বীকার করি না, অথবা তাহার সাধনা সিদ্ধি প্রাপ্ত হইল—আমি এরূপ ভাবি না। আমি সফলতা অন্য প্রণালীতে মাপিতে শিখিয়াছি। আমি কৃতকার্য্যতার মূল্যস্বরূপ সাংসারিক যশোলাভ দেখিতে চাহি না। আমার মতে সেই ব্যক্তিই যথার্থ সফল যে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি, বিঘ্ন-দুর্দ্দৈবের সঙ্গে সংগ্রাম করিয়াছে। কার্য্য উদ্ধার করিতে যাইয়া কোন ব্যক্তি যদি বিফল হয় তাহাতে আমি দুঃখিত হই না। তাহার প্রয়াস, তাহার সাধনা, তাহার দৃঢ়তা, তাহার কর্ত্তব্যনিষ্ঠা ইত্যাদির পরিচয় পাইলেই আমি তাহাকে কৃতকার্য্য, সফল ও সার্থকতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলিব। হয়ত সে জগতে যশস্বী হইল না—হয়ত তাহার নাম সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল না—হয়ত ভবিষ্যসমাজে তাহার কোন স্মৃতি থাকিবে না। তথাপি সে কৃতকার্য্য, কারণ সে দুঃখের সঙ্গে লড়াই করিয়াছে, দারিদ্র্যের বোঝা মাথায় বহিয়াছে—নৈরাশ্যের ভীতিকেই জীবনের এমকাত্র সহায় করিয়া কঠোর কর্ম্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছে।

 ইহাই আমার মতে মনুষ্যত্বের কষ্টিপাথর—সফলতার মাপকাঠি। এই দিক হইতে বিচার করিয়া দেখি নিগ্রোজাতির মধ্যে জন্মিয়া আমার উপকারই হইয়াছে। আমি প্রকৃত জীবন-সংগ্রাম দেখিয়াছি—যথার্থ জীবনের আস্বাদ পাইয়াছি। নিগ্রোজীবনের আব্-হাওয়া দুঃখ-দারিদ্র্যপূর্ণ, নিগ্রোর পক্ষে বিশ্বশক্তি একটা প্রকাণ্ড সয়তান, নিগ্রোর সংসার হতাশ্বাসের লীলানিকেতন। আমি বলি মনুষ্যত্ব-বিকাশের পক্ষে, প্রকৃত জীবনগঠনের পক্ষে এই অবস্থাই অতি হিতকর। কারণ, কষ্টই মানুষের পরীক্ষক, কষ্টই মানুষের বিচারক।

 এই কষ্টের জগতে যাহাকে বাস করিতে হয় তাহারই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা হইয়া থাকে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেই যথার্থ মানুষ হওয়া যায়। তাই বলিতেছিলাম, আমি শ্বেতাঙ্গকে আজকাল হিংসা করি না—নিগ্রো জীবনই আমার শ্রেয়ঃ।

 শ্বেতাঙ্গের কার্য্য উচ্চ অঙ্গের না হইলেও তাহার দোষ বেশী লোক ধরে না। কিন্তু নিগ্রোর কর্ম্মে যদি সামান্যমাত্র ত্রুটিও থাকে তবে তাহার জন্যই সমস্ত পচিয়া যায়। কাজেই নিগ্রো সর্ব্বদা অগ্নি-পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকিতে বাধ্য। খুব ভাল করিয়া না খাটিলে তাহার কাজ বাজারে মনোনীত হইবে না। ইহা কি তাহার উন্নতির পক্ষে কম সুযোগ? কিন্তু শ্বেতাঙ্গের “সাত খুন মাপ।” ফলতঃ তাহার তত বেশী পরিশ্রমী এবং সহিষ্ণু না হইলেও চলে।

 অমি নিগ্রোই থাকিতে চাই। দুঃখের সংসারই আমার শিক্ষালয় থাকুক—জগতের সর্ব্বাপেক্ষা কঠোর সাধনাই আমার জীবনের ব্রত হউক।

 আজকাল নিগ্রোজাতির অনেকেই রাষ্ট্রীয় অধিকারের দাবী করিতে শিখিয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাহারা ব্যক্তিগত যোগ্যতা বাড়াইবার চেষ্টা করে না। কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদিগের সঙ্গে আড়া-আড়ি করিয়া তাহাদের সমান হইতে চায়! আমি তাহাদিগকে বলি “ভাই নিগ্রো, তুমি সাদা কাল চামড়ার প্রভেদ মনে রাখিও না। নিজ কর্ত্তব্যবোধে কর্ত্তব্য করিয়া যাও। যদি শক্তি অর্জ্জন করিতে পার তোমাকে কেহই অস্বীকার করিয়া থাকিতে পারিবে না। বিশ্বের মধ্যে সেই শক্তির স্থান আছেই আছে। গুণ কখনই চাপা থাকিবে না। তাহার সম্মান হইবেই হইবে। তোমরা আজ নির্য্যাতিত পদদলিত, কিন্তু ভগবানের এই সনাতন ধর্ম্মে বিশ্বাস স্থাপন কর। দেখিবে, যথাকালে তোমার শক্তি মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিবে।”