নেপালে বঙ্গনারী/নেপালের কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্থান

উইকিসংকলন থেকে

নেপালের কয়েকটি প্রসিদ্ধ স্থান

 ঘর্ঘরা প্রদেশ—জুমলা, ডোটী, এবং সালিয়ানি প্রদেশে বিভক্ত,—পূর্ব্বে ইহা দ্বাবিংশটী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ছিল এবং বাইশ রাজ্যের অন্তর্ভূত ছিল। বাইশরাজ জুমলার রাজার করদ ছিলেন। বাইশ রাজ্যের উত্তর পশ্চিমে জুমলা রাজ্য স্থাপিত। বর্ত্তমান সময়ে জুমলা এবং বাইশ রাজ নেপালের গুর্খারাজার সামন্ত রাজা। জুমলার দক্ষিণ পশ্চিমে ডোটি রাজ্য। ডোটি নেপালের পশ্চিমতম প্রান্তে স্থিত—ইহার রাজধানীও ডোটী। এখানে নেপাল রাজের গড় এবং সৈন্য আছে। ডোটী সহরে ৪৫ শত গৃহ আছে। ডোটী বারেলীর ৮৫ মাইল উত্তরপূর্ব্বে অবস্থিত এবং আলমোরার ৭০ মাইল দক্ষিণপূর্বে। ডোটী হইতে কাটমণ্ডু যাইবার পথ ১৬২ ক্রোশ হইবে।

 সালিয়ানি—ডোটী প্রদেশের পূর্ব্বে সালিয়ানি। এই প্রদেশ দিয়া রাপ্তি নদী প্রবাহিত। সালিয়ানি লক্ষৌর ১২০ ক্রোশ উত্তরে।

 পেনটানা।—সালিয়ানির পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তরপূর্ব্বে পেনটানা সহর এবং কাটমণ্ডুর ৮৬ ক্রোশ পশ্চিমে। এখানে নেপালরাজের বারুদ বন্দুক প্রভৃতি নির্ম্মিত হয়। এই প্রদেশে বিস্তর সোরা আছে।

 সপ্ত গণ্ডকী প্রদেশ—গণ্ডকী প্রদেশ চরিটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত; (১) মালিরাম, (২) কাচি, (৪) পালপা, (৩) ধবলগিরি। ধবলগিরি হইতে গোঁসাইথান পর্ব্বতের দক্ষিণে,— ইহাই সপ্তগণ্ডকী প্রদেশ। গণ্ডকীর সপ্তশাখা এই প্রদেশে প্রবাহিত। ইহা নেপালের মধ্যাংশ। গণ্ডকীর এই সপ্তশাখা যথাক্রমে (১) বরিগর (২) নারায়ণী (৩) সইত গণ্ডকী (৪) মারসংতি (৫) দারামদি (৬) গণ্ডী (৭) ত্রিশূলগঙ্গা।

 ত্রিশূলগঙ্গা—গণ্ডকী প্রদেশের পূর্ব্বতম সীমান্তবর্ত্তিণী। নদী। গোঁসাইথান পর্ব্বতের শিখরস্থিত দ্বাবিংশতি হ্রদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বৃহত্তম হ্রদে ইহার জন্ম।

 গোঁসাইথান—নেপালের একটী উন্নত শিখর। গোঁসাইথান নেপালীদের এক প্রধান তীর্থ। গোঁসাইথানের চিরতুষারাবৃত শিখরের নিম্নেই স্তরে স্তরে দ্বাবিংশতিটী তুষার বারিপূর্ণ হ্রদ আছে। এই সকল হ্রদের নিম্নে জিবজিবিয়া পর্ব্বতমালা প্রকার স্বরূপ হইয়া দণ্ডায়মান আছে। এই জিবজিবিয়া দক্ষিনমুখী হইয়া অবশেষে কাঠমণ্ডু উপত্যকার উত্তরে ১৫০০০ ফিট উন্নত মস্তক উত্তোলন করিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। গোঁসাইথানের বৃহত্তম হ্রদই নীলকণ্ঠকুণ্ড নামে প্রসিদ্ধ। নেপালে এরূপ কথিত আছে, সমুদ্র মন্থন কালে কালকুট পান করিয়া বিষের যন্ত্রণায় মহাদেব হিমালয়ে প্রস্থান করিয়াছিলেন এবং গোঁসাইথানের হিমজলে অবগাহন করিয়া শীতল হইয়াছিলেন, তাঁহার ত্রিশূলের আঘাতে হিমালয়ের বক্ষ ভেদ করিয়া ত্রিশূলগঙ্গা প্রবাহিত হইল এবং ত্রিশূলগঙ্গার জল পান করিয়া নীলকণ্ঠের জ্বালা বিদূরিত হইল। এক্ষণে নীলকণ্ঠকুণ্ডের মধ্যে একটী পর্ব্বত নিমজ্জিত আছে, তীর্থযাত্রীগণ তাহাকে প্রকৃত নীলকণ্ঠ বিবেচনা করিয়া ভক্তিগদ হৃদয়ে নিরীক্ষণ করে। কিন্তু সেই হ্রদের তুষার শীতলজল কেহই স্পর্শ করিতে পারে না। কাটমণ্ডু উপত্যকা হইতে শত শত যাত্রী গোঁসাইথানে তীর্থ করিতে যায়। গোঁসাইথানের পথ অতি বিপদজনক। পথে কোন আশ্রয় নাই, কোন প্রকার খাদ্যের সংস্থান নাই, শীতও অতি দুরন্ত। ভীষণ শীতে যাত্রীগণ বাহিরেই রাত্রি যাপন করে। পথের দারুন কষ্টে অনেকের প্রাণ বিয়োগ হয়; তথাপি কষ্ট স্বীকার করিয়াও দলে দলে লোক গোঁসাইথানে গমন করে।

 নায়কোট—নায়াকোটের উপত্যকা দিয়া ত্রিশূলগঙ্গা প্রবাহিত হইয়াছে। এই উপত্যকায় প্রচুর পরিমানে ফল শষ্য জন্মে। কিন্তু এখানে ম্যালেরিয়ার বড়ই প্রদুর্ভাব। গণ্ডকী নদীর পশ্চিম তটে পশ্চিম নায়াকোট। দ্বাদশ শতাব্দীতে মুসলমান অত্যাচারে অস্থির হইয়া রাজপুতগণ প্রথমে এখানে আশ্রয়লাভ করে। পরে গোরখালি নামক প্রদেশ অধিকার করিয়া স্থায়ীরূপে বাস করে। গোরখালি হইতে এই গোর্খা নামের উৎপত্তি।

 পাল্‌পা-কাটমণ্ডু হইতে ৬৩ ক্রোশ এবং বিটুলের নয় ক্রোশ উত্তর পশ্চিমে ইহা অবস্থিত। পালপার পাঁচ মাইল দূরে নেপাল রাজের একটী প্রধান সৈন্যাবাস আছে। পালপার শাসন কর্ত্তা সর্ব্বদাই রাজবংশসম্ভূত ব্যক্তিগণ হইয়া থাকেন। এই স্থানে মুদ্রাসকল প্রস্তুত হইয়া থাকে। পালপার অন্তর্গত গুলমি নামে এক স্থান আছে। কাটমণ্ডুর গুর্খা রাজা পালপা এবং গুলমি জয় করিয়াছিলেন। রণবাহাদুর গুলমি অধিকার করিয়া গুলমি রাজার কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন—রণবাহাদুর পালপার রাজকুমারীরও পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।

 পোখরা—গোর্খা প্রদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে,—পালপার সন্নিকটে পোখরার উপত্যকা অবস্থিত। পোখরা সহরটী উক্ত প্রদেশের প্রধান সহর। অন্যান্য প্রদেশ অপেক্ষা এখানকার জনসংখ্যা অধিক; পোখরায় তাম্র পাত্র প্রস্তুত হয়। এখানে একটি বার্ষিক মেলা হয় তাহাতে প্রচুর শষ্য ও এই প্রদেশের কৃষিজাত দ্রব্য আমদানি হইয়া থাকে। পোখরার উপত্যকা কাটমণ্ডুর উপত্যকা অপেক্ষা বিস্তীর্ণ; এখানে অনেক গুলি হ্রদ আছে এবং এই কারণেই স্থানটীর নাম পোখরা হইয়াছে। আমরা যাহাকে পুষ্করিণী বা চলিত ভাষায় পুকুর বলি নেপালীরা তাহাকে পোখরী বলিয়া থাকে। এই উপত্যকার বৃহৎ হ্রদটী এত বিস্তৃত যে তাহাকে প্রদক্ষিণ করিতে দুই দিবস সময় যায়।

 কিন্তু দুঃখের বিষয় এই হ্রদের জল এতই নীচে যে কোন প্রকারে ব্যবহৃত হইতে পারে না। কাঠমণ্ডুর উপত্যকার ন্যায় এস্থান নদী বহুল নয়। জলের অভাবে কৃষিকর্ম্মের বিশেষ অন্তরায় ঘটিয়া থাকে। অধিকাংশ স্থলে কোন চাষবাস হয় না।

 কুশী প্রদেশ—নেপালের পূর্ব্বাংশ দিয়া কুশী এবং তাহার উপনদী সকল প্রবাহিত—এই হেতু ইহাকে কুশী প্রদেশ কহিয়া থাকে—গোঁসাইথান হইতে গৌরীশঙ্কর বা এবারেষ্ট পর্য্যন্ত পর্ব্বতমালার দক্ষিণে কুশী প্রদেশ অবস্থিত। গণ্ডকীর ন্যায় কুশীরও সপ্ত শাখা আছে, এই জন্য ইহাকে সপ্তকুশী বলে। কুশীর সপ্তশাখা যথাক্রমে (১) নিলামচি, (২) ভুটিয়া কুশী, (৬) তানাকুশী, (৪) লিখু, (৫) দুধকুশী, (৬) আরান, (৭) তামোর। কুশী প্রদেশের উত্তর সীমায় কুটী, হংতিয়া এবং ওয়ানাং পাশ অবস্থিত। সিম্‌লালিয়া পর্ব্বতমালা দ্বারা কুশী প্রদেশ সিকিম হইতে বিভক্ত। মিচি নদীই উভয় রাজ্যের সীমা। নেপালের পূর্ব্বতম সীমায় ইলাম নামে একটী ক্ষুদ্র নগর আছে। সিকিম হইতে এবং দারজিলিং হইতে নেপালীগণ সর্ব্বদাই ইলাম হইয়া নেপালে যাতায়াত করিয়া থাকে।