পত্রাবলী (১৯১২-১৯৩২)/১৪০
পরম পূজনীয়া মা,
শ্রীচরণেষু—
আপনার ৬ই তারিখের চিঠি ৯ই তারিখে পেয়েছি। আমি ২নং বেলতলা রোডের ঠিকানায় ইতিপূর্ব্বে যে ২।৩ খানা চিঠি দিয়েছি আশা করি তাহা পেয়েছেন।
আমার বিজয়ার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করবেন।
আপনি লিখেছেন—“কোনও বিষয়ে আমার সাহায্য তোমরা আশা করো না।” একথাগুলি প’ড়ে বড় ব্যথিত হয়েছি; ব্যথিত হয়েছি নিজের জন্য নয়, দেশের কথা ভেবে। আজ বাংলার বড় দুর্দ্দিন। Wholetime কর্ম্মীর বড় অভাব। মিঃ সেনগুপ্ত কংগ্রেসের কাজ একরকম ছেড়ে দিয়েছেন বললে অত্যুক্তি হয় না। কিরণবাবু আমাকে নোটিশ দিয়েছেন যে অক্টোবর মাস থেকে তিনি আমার উপর বোঝা চাপিয়ে অবসর গ্রহণ করবেন। তুলসীবাবুর দেশের কাজে আর বিশেষ উৎসাহ বা আগ্রহ আমি দেখি না। Big Five-দের আপনি জানেন; তুলসীবাবু বাদে তাঁহারা professional লোক, সুতরাং কংগ্রেসের কাজে তাঁহারা বেশী সময় দিতে পারেন না। আপাততঃ এক বিধানবাবুই B. P. C. C-র কাজে interest রাখেন; কিন্তু তাঁহারও সময় অল্প। কংগ্রেসের ভাণ্ডার একেবারে শূন্য। দেশবন্ধুর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে একজনকেও দেশের কাজে পাওয়া যায় না। আমাদের একমাত্র ভরসা আপনি— কিন্তু আপনিও সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চান। এই সব দেখে শুনে কয়েকদিন যাবৎ আমি ভাবছি আমারই বা এত মাথাব্যথা কেন যে নিজের আত্মিক অকল্যাণ সাধন করে আমাকে এই ভূতের বোঝা বইতে হবে। রাজনীতি আমার উপযুক্ত কর্ম্মক্ষেত্র নয়; আমি কেবল ঘটনাচক্রে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত্তের মধ্যে এসে পড়েছি। এখন এই অবসরে আমিও আমার উপযুক্ত কর্ম্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারি। সংসারে আমার আসক্তি নাই, তাই আমি সংসার ধর্ম্মে প্রবেশ করলাম না। দেশের বর্ত্তমান অবস্থায় আমি কেন শান্তির পথ ছেড়ে নূতন সংসার-জাল রচনা করে তার মধ্যে প্রবেশ করব, তার কোনও কারণ খুঁজে পাই না।
দেশ আপনাকে চায়—রাজবন্দীরা আপনাকে চায়। সকলে আমাকে বার ২ অনুরোধ করেছে যেন আমি আপনাকে তাহাদের কথা নিবেদন করি। আমিও অহঙ্কারপরবশ হ’য়ে মনে করেছি যে আমি তাহাদের বার্তাবহ হ’য়ে গেলে আপনি সে কথা ঠেলতে পারবেন না। ভগবান আমার সে অহঙ্কার চূর্ণ করেছেন। বড় আশা নিয়ে আমি জেল থেকে বাহির হয়েছিলাম, এখন দেখছি সে আশা অমূলক। যাঁহাদের উপর খুব বেশী ভরসা ছিল তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই দেশের কাজ করা দূরে থাকুক, দেশের সমস্যা বিষয়ে চিন্তা করতে চান না। কংগ্রেসের বর্ত্তমান অবস্থার কথা ভাবলে চোখ ফেটে জল আসে। কংগ্রেসের যে কঙ্কাল আজ আমাদের সামনে পড়ে আছে—এই কঙ্কালের জন্যই কি দেশবন্ধু তাঁহার অমূল্য জীবন দিয়ে গেলেন? দেশবন্ধুর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্ম্মী অনুচর— যাঁহারা তাঁহাকে খুব ভাল রকম চিনবার ও বুঝবার অবসর পেয়েছিলেন—তাঁহাদেরই আজ দেশের কাজে সব চেয়ে বেশী অনাস্থা। ইহারই বা কারণ কি?
দেশবন্ধুর দেহত্যাগের পর যাঁহারা কর্ত্ত্বব্য অবহেলা করেছেন তাঁহাদের মধ্যে আপনি সর্ব্বপ্রধান— কারণ তাঁহার দেহ চলে গেলেও আপনার মধ্যে তাঁহার আত্মা—তাঁহার অতৃপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা বিরাজ করছে। সেই আত্মার প্রতীকস্বরূপ হ’য়েও, এবং আপনার এত প্রভাব থাকা সত্ত্বেও, আপনি কিছু করতে চান না। বড় দুঃখে একথা আমি বলছি—আমার ধৃষ্টতা মার্জ্জনা করবেন। আমি শেষ বারের মত হৃদয়ের বেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করছি। আর আপনাকে বিরক্ত করব না।
আমি মনে করেছিলাম এই মাসের শেষে অথবা নভেম্বরের গোড়ায় আপনার কাছে একবার যাব। এখন দেখছি যে গিয়ে কোনও লাভ নাই। নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। যাহা নিজের ক্ষমতার বাইরে তার জন্য চেষ্টা করে লাভ নাই। বাঙ্গলা দেশের বড় দুর্ভাগ্য—তাহা না হ’লে এত অল্প সময়ের মধ্যে কংগ্রেসের এই দুরবস্থা ঘটত না।
আর একটি কথা বলে আমি ক্ষান্ত হ’ব। জীবনে কাহারও কখনও খোসামুদি করি নাই—অপরের মন যুগিয়ে কথা বলার রীতি আমার জানা নাই। আমাদের Leader-এর জীবদ্দশায় যখন সকলেই তাঁহাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তাঁহার মনের মত কথা বলেছেন, আমি তখন অপ্রিয় সত্য বলে তাঁহার সহিত ঝগড়া করেছি। আপনাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য কোনও কথা বলি নাই বা বলব না। দেশবাসী আপনাকে চায়—আপনার উপর তাহাদের অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে। সকল দল আপনাকে মানবে, আপনাকে খাতির করবে, আপনার কথা রাখবে। এ কথা সত্য বলে বিশ্বাস করি ব’লে আপনাকে জানিয়েছি। আপনাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য অথবা আপনার খোসামুদি করবার জন্য এ কথা বলি নাই বা বলব না। দেশবাসীর হৃদয়ে আপনার স্থান কোথায়—দেশের মধ্যে আপনার position কি, তাহা জানি বলেই আপনাকে জানিয়েছি।
দেশের মধ্যে কোনও দল আপনাকে exploit করবে আমি তাহা চাই না। আমার যদি আশঙ্কা থাকত যে কোনও দল আপনাকে exploit ক’রে স্বীয় প্রতিপত্তি স্থাপন করতে চায়, আমি তাহা হইলে আপনাকে সে কথা জানাতাম। আপনাকে শুধু কোনও দল বিশেষ চায় না—সমগ্র দেশ আপনাকে চায়। আপনি দেশের কাজে বড় asset—সুতরাং আপনাকে আমরা সর্ব্বদা দলাদলির বাহিরে রাখতে চাই। দেশ আপনাকে চায়—exploit করবার জন্য নয়, follow করবার জন্য।
আপনার একটা individuality আছে—দেশবন্ধুর জীবদ্দশায়ও আপনার individuality ছিল—সেইজন্য আপনার শক্তির উপর জনসাধারণের এত বিশ্বাস। দেশের মধ্যে যেটা better mind—সেটা একেবারে unreasonable নয়। Better minds-রা আপনার কাছ থেকে অন্যায় কিছু দাবী করে না। তাহারা চায় না যে আপনাকে পথে, ঘাটে, মাঠে ঘোরাঘুরি করে, বক্তৃতা করে বেড়াতে হবে। তাহারা চায় দেশের কাজে আপনার আস্থা ও উৎসাহ—তাহারা চায় আপনার উপদেশ ও পরামর্শ—তাহারা চায় জগতে ঘোষণা করতে যে দেশবন্ধুর আরব্ধ কাজসমূহ আপনি ব্রতস্বরূপ গ্রহণ করেছেন—তাহারা শুধু চায় দেখতে যে দেশবন্ধুর অতৃপ্ত আশা-আকাঙক্ষা আপনার জীবনে সফল ও সার্থক হয়ে উঠছে।
যাহারা দেশবন্ধুকে সুখে দুঃখে অনুসরণ করেছে—আজও তাহারা সেই devotion-এর সহিত আপনাকে অনুসরণ করতে প্রস্তুত। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তবে একবার পরীক্ষা করে দেখুন। আপনার কথায় বাঙ্গলা দেশ ওঠে বসে কিনা তা আপনি ইচ্ছা করলেই পরীক্ষা করতে পারেন।
যাক্ অনেক কথা লিখে ফেললাম—অন্যায় বলে থাকলে ক্ষমা করবেন। আমি ভাড়াটিয়া সৈনিক নহি। সহজে কোথাও আত্মসমর্পণ করি না—কিন্তু যেখানে করি, সেখান থেকে সহজে ফিরি না। আমার loyalty and devotion-এর উপর আপনার পূর্ণ দাবী সর্ব্বদাই থাকবে—আপনি তাহা use করুন বা না করুন। আপাততঃ আমাকে নিজের পথ নিজেই স্থির করতে হবে। সে পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা এখনও স্থির করতে পারি নাই।
এখানে বোধ হয় বেশীদিন থাকব না—সুতরাং পত্র দিলে কলকাতার ঠিকানায় দেওয়া ভাল। November-এর programme স্থির করি নাই—কলকাতার বাহিরে (কার্শিয়াং-এ অথবা পশ্চিমে) কাটাতে পারি। আপনাদের কুশল সংবাদ পেলে সুখী হ’ব। ইতি—
সুভাষ
পুনঃ—খবর কাগজে দেখলাম যে Madame Zaghul তাঁহার পরলোকগত স্বামী জগলুল পাশার কর্ম্মভার নিজে গ্রহণ করেছেন। Madame Sun-yat-Sen বহুকাল যাবৎ তাঁহার মৃত স্বামীর কাজ করে আসছেন। সমগ্র Egyptian জাতি Madame Zaghlul-কে “মা” বলে গ্রহণ করেছে—তাহাদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তিনি প্রত্যাখ্যান করেন নাই। কিন্তু ভারতবর্ষই হতভাগ্য!