এই চোদ্দজন মনু-ই হিন্দু-ধর্মশাস্ত্র বা হিন্দু-ধর্মীয় আইনের সৃষ্টা। এই ধর্মীয় আইন ‘মনু সংহিতা’ রচনা করেন। ‘মনু সংহিতা’ বেদ পরবর্তীকালে রচিত এবং কয়েকশো বছর ধরে রচিত। আইনকর্তা মনুরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যার প্রধান শর্ত হলো ‘অন্ধ শাস্ত্র-বিশ্বাস’। শ্রমিক ও শোষিতদের অভ্যুত্থান সম্ভাবনা রোধ করতে এবং তাদেরকে দাবিয়ে রাখতে মনু তৈরি করেছিলেন বিশেষ দর্শন—মতাদর্শগত শক্তি।
মনুও কিন্তু যুক্তিবাদীদের যুক্তিতর্কের আক্রমণের কথা ভেবে শঙ্কিত ছিলেন। যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ব্যাপকতা পেলে, সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেলে, প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিতই টলে যেতে পারে—যে সমাজব্যবস্থায় একদল শুধুই খাটবে আর একদল ভোগ করবে সেই খাটনির ফল।
মুক্তচিন্তার বিরোধী ‘মনু সংহিতা’
সাধারণ মানুষের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে রামায়ণ মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও ঢুকে পড়েছে অনেক কাহিনি, অনেক নীতিকথা। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের দিকে তাকান। রামচন্দ্র তখন চিত্রকূটে। ভরত এলেন। রামচন্দ্র ভরতকে রাজ্য-পরিচালন বিষয়ে উপদেশ দিতে গিয়ে একসময় বলেছেন,
ক্কচিন লোকায়তিকান্ ব্রাহ্মণাংস্তাত সেবসে।
অনর্থকুশলা হ্যেতে বালাঃ পণ্ডিতমানিনঃ॥
অর্থাৎ, “আশা করি তুমি লোকায়তিক (যুক্তিবাদী) ব্রাহ্মণদের সেবা করছ না। ওরা অনর্থ ঘটাতে খুবই পটু।”
মহাভারতের শান্তিপর্ব। এক ধনী বণিক রথে যাওয়ার সময় এক ব্রাহ্মণকে ধাক্কা মারে। ক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণ অপমান জ্বালা ভুলতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করে। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের আত্মহত্যার মধ্যে সর্বনাশের সংকেত দেখতে পেয়ে শেয়াল সেজে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণকে পশুজীবনের বহু কষ্টের কথা বলে মানব জীবনের জয়গান গাইলেন। জানালেন, অনেক জন্মের পূণ্যের ফল সঞ্চয় করে এই মানবজন্ম পাওয়া। এমন মহার্ঘতম মানবজীবন, বিশেষত শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মলাভের পরেও কেউ কী পারে সে-জীবনকে ধ্বংস করতে? অভিমানে আত্মহত্যা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শেয়াল আরও জানালেন, নিজেও আগের জন্মে ব্রাহ্মণ হয়েই জন্মেছিলেন। কিন্তু সে-জন্মে চূড়ান্ত মুর্খের মতো এক মহাপাতকের কাজ করেছিলেন বলেই আজ এই শিয়াল-জন্ম।
চূড়ান্ত মূর্খের মতো মহাপাতকের কাজটা কী? এ-বারই বেরিয়ে এলো নীতিকথা—
অহমাসং পণ্ডিতকো হৈতুকো বেদনিন্দকঃ।
আন্বীক্ষিকীং তর্কবিদ্যাম্ অনুরক্তো নিরর্থিকাম্॥