কোটী টাকা এই বাবদ লইয়াছেন। যদি এই বিপুল অর্থের শতকরা এক ভাগও দুর্গতদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হইত, তবে তাহারা হয়ত বাঁচিতে পারিত। কিন্তু তাহা হইলে অন্য দিকে যে সব অমিতব্যয়িতা অপব্যয়ের দৃষ্টান্ত দেখা যায়, তাহা সম্ভবপর হইত না।
বাংলা দেশে প্রায়ই যে সব বন্যা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহা হইতে শিক্ষা করিবার অনেক বিষয় আছে। আমাদের জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির পরিমাণ কি এবং জাতীয় জীবনের বিকাশের পথে এই বাধা বিপত্তির বিরুদ্ধে আমরা কিরূপে সংগ্রাম করিতে পারি, তাহা এই সব বন্যা ও দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়া প্রকাশিত হইয়াছে।
বাংলা গবর্ণমেণ্ট বন্যার ধ্বংসলীলা ও তজ্জনিত অপরিমেয় ক্ষতি লঘু করিয়া দেখাইবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করিয়াছেন। গবর্ণমেণ্ট বন্যা-বিধস্ত অঞ্চলের ক্ষতি সম্বন্ধে হাস্যকর বিবরণ প্রকাশ করেন এবং একটি নিখিল বঙ্গ সাহায্য ভাণ্ডার খোলাও প্রয়োজন মনে করেন না।
গবর্ণমেণ্ট যদি তাঁহাদের সরকারী দস্তুর মাফিক সাহায্য কার্যের বন্দোবস্ত করিতেন, তাহা হইলে সাহায্য কার্যের জন্য প্রদত্ত অর্থের কতটা অংশ বড় বড় কর্মচারীদের মোটা মাহিনা ও গাড়ীখরচা বাবদ ব্যয় হইত? খুব সম্ভব আসল কাজ অপেক্ষা পরিদর্শনের কাজেই বেশী টাকা লাগিত। বে-সরকারী স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানগুলির কাজই অধিকতর স্বল্প ব্যয়ে এবং দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়, কেননা সেখানে সরকারী লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নাই!
বন্যা বাংলার যুবকদিগকে নিয়মানুবর্তিতা ও দৃঢ়সঙ্কল্পের শিক্ষা দিয়াছে। ইহা হাতেকলমে আমাদিগকে স্বায়ত্তশাসনের কাজ শিখাইয়াছে। পূর্বে বন্যার সময়, সাহায্য কার্য তিন সপ্তাহ বা একমাসের বেশী স্থায়ী হইত না, উহা কতকটা প্রাথমিক সাহায্য স্বরূপ ছিল। বন্যার ভীষণতা একটু কমিলেই সাহায্য কার্য বন্ধ করা হইত এবং হতভাগ্য অধিবাসীদের নিজেদের অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিতে হইত। যতদূর সম্ভব তাহাদিগকে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করিবার কোন চেষ্টা হইত না।
কিন্তু বন্যার সম্বন্ধে একটা খুব বড় কথা এই যে—হিন্দু মুসলমান মিলনের সমস্যা এই বন্যা সেবাকার্যের মধ্য দিয়া আশাপ্রদ বলিয়া মনে হয়। যাঁহারা এই মিলন সম্ভবপর মনে করেন না, তাঁহাদিগকে আমি জানাইতে চাই যে, বন্যাপীড়িতদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ জনই ছিল মুসলমান এবং যাহারা সাহায্য কার্য করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে শতকরা প্রায় ১৯ জনই ছিল হিন্দু এবং আমি নিশ্চিতরূপে বলিতে পারি যে, কোন হিন্দুই, মুসলমান ভ্রাতাদের সাহায্যের জন্য যে সময় ও শক্তি ব্যয়িত হইয়াছে, তাহাতে আপত্তি করে নাই। রাজনৈতিক প্যাক্ট ও আপোষ সফল হইতে না পারে, কিন্তু এই আন্তরিক সেবা ও সহানভূতির দৃঢ় ভিত্তির উপর যে বন্ধুত্ব গড়িয়া উঠে, তাহার ক্ষয় নাই।
এই বন্যার মধ্য দিয়া আমরা ভবিষ্যৎ যুক্ত ভারতের স্বপ্ন দেখিয়াছি। বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন রকমের জলবায়ু, বিভিন্ন ভাষা, বিচিত্র রকমের বেশভূষা, বিভিন্ন ধর্ম এবং বিভিন্ন রকমের মতামত থাকা সত্ত্বেও, ভারতবর্ষ যে একটি অখণ্ড দেশ তাহা আজ আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ইহার কোন অংশে কোন বিপদ বা বিপত্তি ঘটিলেই সমস্ত অঙ্গই গভীর আন্তরিকতা ও সমবেদনার সঙ্গে তাহাতে সাড়া দেয়।