বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/২৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫২
আত্মচরিত

খাদি প্রতিষ্ঠান প্রতিবৎসর ৪।৫ হাজার টাকা লোকসান দিয়া কোন প্রকারে টিকিয়া আছে। যাহা হউক, আমরা এই প্রচেষ্টা ত্যাগ করি নাই, কেন না কয়েকটি স্থানে অনাথা বিধবারা ও তাহাদের কন্যা, পুত্রবধূ, প্রভৃতি চরকার উপকারিতা বুঝিতে পারিয়া উহা অবলম্বন করিয়া আছে। ফলে যে স্থলে প্রথম অবস্থায় ৮।১০ নম্বরের সূতা হইত, সে স্থলে এখন ৩০।৪০ নম্বরের সূতা হইতেছে। কাটুনীরা পূর্বেকার মত দক্ষতা লাভ করাতে সূতার মূল্য হ্রাস করিতে পারা গিয়াছে। যাহারা পুরা সময়ে সূতা কাটে তাহারা দৈনিক দুই আনা রোজগার করে, আংশিক সময়ে সূতা কাটিলে এক আনা উপার্জন করিতে পারে। ১৯৩১ সালে পাটের মূল্য অসম্ভব রকমে হ্রাস হওয়াতে, আমরা বহু কাটুনীর নিকট হইতে আবেদন পাইয়াছি। জগদ্ব্যাপী মন্দার পরে, পুনর্বার বন্যা হওয়াতে দুর্দশা চরমে উঠে এবং চারিদিকে “চরকা দাও, চরকা দাও” রব উঠে। কলিকাতার বিভিন্ন সেবাসমিতি চাউল প্রভৃতি বিতরণ করিয়া যে সাহায্য করিতেছে, তাহাতে দুর্দশাগ্রস্ত অঞ্চলের দুঃখ অতি সামান্যই লাঘব হইতেছে। তাহার উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা মন্দ হওয়াতে অর্থ সাহায্যও অতি সামান্য পাওয়া যাইতেছে। যদি চরকা প্রচলিত থাকিত, তবে ৭ বৎসর বয়সের ঊর্ধ্বে বালক বালিকা হইতে আরম্ভ করিয়া, প্রত্যেক কার্যক্ষম কাটুনী গড়ে এক আনা করিয়া উপার্জন করিতে পারিত, এবং উহার দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তির চাউল, তেল, লবণ, ডাল প্রভৃতির সংস্থান হইত। কাহারও নিকট অর্থের অফুরন্ত ভাণ্ডার নাই, ভাণ্ডার শূন্য হইয়া আসিলে সাহায্য কার্যও থামিয়া যায় এবং দুর্গতদের অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিতে হয়। তাহা ছাড়া, প্রথম প্রথম সাহায্য বিতরণের প্রয়োজন থাকিলেও, উহার একটা অনিষ্টকর দিকও আছে। উহার ফলে সাহায্যদাতা ও গ্রহীতা উভয়েরই নৈতিক অধঃপতন হয়। কিন্তু গ্রহীতা যদি সাহায্যের পরিবর্তে কোন একটি কাজ করিয়া দিতে পারে, তবে তাহার আত্মসম্মান বজায় থাকে। সূতার একটা বাজার মূল্যও আছে, সতরাং সূতা বিক্রয়ের পয়সা কাটুনীদের ভরণপোষণের কাজেই লাগে এবং এইরূপে কর্মচক্র আবর্তিত হইতে থাকে।

 কলিকাতার রাস্তায় দুই তিন টন এমন কি চার পাঁচ টন ভারবাহী মোটর লরী চলে। কয়েক বৎসর হইতে কয়েক সহস্র মনুষ্য-বাহিত যানেরও আমদানী হইয়াছে। এগুলিতে পাঁচ, দশ, পনর, কুড়ি মণ পর্যন্ত মাল বহন করা হয়। ছোট যানগুলি একজন কি দুইজন লোকে টানে, বড় গুলির সম্মুখে দুই জন টানে, পিছনে দুই জন ঠেলে। এখানে দেখা যাইতেছে, মানষ কেবল গরু, বা মহিষের গাড়ীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতেছে না, মোটর চালিত যানের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করিতেছে। প্রকৃত কথা এই যে, এই সমস্ত কঠোর পরিশ্রমী লোক বিহার ও যুক্তপ্রদেশ হইতে আসে, ঐ দুই প্রদেশে লোকসংখ্যা বেশী হওয়াতে, উহাদের পক্ষে জীবিকার্জন করা কঠিন। সুতরাং মানুষ শ্রমিক যে যন্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিতে পারে না, ভারত ও চীনে এই নিয়ম খাটে না। এই দুই দেশের অর্দ্ধাশন-ক্লিষ্ট লক্ষ লক্ষ লোক এমন কম মজুরীতে কাজ করিবার জন্য আগ্রহান্বিত যে, শিল্প বাণিজ্যে সমৃদ্ধ অন্য কোন দেশে, তাহা অতি তুচ্ছ বলিয়া বিবেচিত হইবে।

 শ্রীযুত ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক শতাব্দী বা ততোধিক পূর্বেকার সংবাদপত্র ঘাঁটিয়া যে সমস্ত মূল্যবান, তথ্য প্রকাশ করিতেছেন, সেজন্য তিনি দেশবাসীর ধন্যবাদার্হ। পুরাতন ‘সমাচার দর্পণ’ হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত পত্রখানি হইতে বুঝা যাইবে চরকার জন্য কোলব্রুক সাহেবের বিলাপের কারণ কি এবং বিদেশী সূতা ভারতের কি বিষম আর্থিক ক্ষতি করিয়াছে।

“চরকা আমার ভাতার পুত
চরকা আমার নাতি—”