ঢাকা, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায়—এখন পাট উৎপন্ন হয়। যেখানে যত জমি পাওয়া যায়, তাহা এই পাটচাষের কাজে লাগানো হইতেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, গোচারণ তথা দুগ্ধ সরবরাহের পক্ষে ইহা অত্যন্ত ক্ষতিকর হইতেছে।
বাংলার কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উপর পাট যেরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে, তাহা পানাণ্ডিকরের Wealth and Welfare of the Bengal Delta নামক গ্রন্থে সুন্দররূপে বর্ণিত হইয়াছে। গ্রন্থকার যে বিষয়টি নিপুণভাবে পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা করিয়াছেন, তাহা বর্ণনা হইতে সহজেই বুঝা যায়।
“বাংলায় পাটচাষের বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বাজারে পাটের চাহিদা বাংলার লোকদের পক্ষে প্রভূত কল্যাণকর হইত, যদি তাহারা বুদ্ধিমান ও হিসাবী হইত এবং এই লাভের টাকা হইতে দেনা শোধ, জমির উন্নতি, পথঘাটের উন্নতি এবং জীবনযাত্রার আদর্শ উন্নত করিতে পারিত। তাহাদের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য সামান্য কিছু বাড়িয়াছে বটে, কিন্তু বেশীর ভাগ টাকাই মামলা মোকদ্দমায়, নানারূপ বিলাসব্যসনে এবং বাহির হইতে মঞ্জুর আমদানী করিয়া তাহাদের খরচা বাবদ তাহারা অপব্যয় করিয়া ফেলিয়াছে। কৃষকেরা বিলাসী ভদ্রলোক হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং আলস্যে সময় কাটাইতে শিখিয়াছে। তাহারা আর নিজে মাটীর কাজ করে না, ধান ও পাট কাটে না, জলে পাট ডুবায় না, ক্ষেত হইতে শস্য বাড়ীতে লইয়া যায় না; এই সমস্ত কাজের জন্য তাহারা বিহার ও যুক্তপ্রদেশ হইতে আগত মজুরদের নিয়োগ করিতেছে। ইহার ফলে মজুরের চাহিদা ও মূল্য বাড়িয়া গিয়াছে এবং সঙ্গে সঙ্গে চাষের খরচাও বাড়িয়া গিয়াছে। এইভাবে কৃষকদের লাভের একটা মোটা অংশ একদিকে উকীল মোক্তার, অন্যদিকে হিন্দুস্থানী মজুরদের হাতে চলিয়া যাইতেছে। বর্তমানে ব্যবসা বাণিজ্য মন্দা হওয়ার দরূণ কৃষিজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস পাইয়াছে। কিন্তু কৃষকেরা একবার যে মজুর খাটাইবার অভ্যাস করিয়া ফেলিয়াছে, তাহা আর ছাড়িতে পারিতেছে না[১], এখনও তাহারা বাহিরের মজুর সমভাবেই খাটাইতেছে। যদি এইভাবে চাষের খরচা না বাড়িয়া যাইত, তবে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য হ্রাস হওয়া সত্ত্বেও চাষীদের যথেষ্ট লাভ থাকিত।”
পাঁচ বৎসরের হিসাব ধরিয়া দেখা গিয়াছে যে, বাংলাদেশে উৎপন্ন পাটের পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৪ কোটী ৭৫ লক্ষ মণ। বাংলাদেশের লোকসংখ্যাও প্রায় ৪ কোটী ৭৫ লক্ষ। সুতরাং মাথাপিছু গড়ে বার্ষিক এক মণ পাট উৎপন্ন হয়; প্রতি মণ পাটের মূল্য প্রায় আট টাকা।[২] স্যার ডি. এম. হ্যামিলটন ১৯১৮ সালে কলিকাতায় একটি বক্তৃতা করেন, এই প্রসঙ্গে তাহা হইতে আমি কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি। তিনি বলেন:—“আমার কয়েকটি পাটকলের অংশ আছে, সেই হিসাবে আমি পাট উৎপন্নকারী কৃষকদের মুখের দিকে চাহিতে লজ্জা বোধ করি। আমরা শতকরা ১০০ ভাগ লাভ করিব। আর ঐ কৃষকেরা কোনরূপ ব্যাঙ্কের ব্যবস্থার অভাবে, দুর্দিনে না খাইয়া মরিবে, ইহা ব্রিটিশ বিচার বুদ্ধি ও ন্যায়ের আদর্শ সম্মত নহে। ডাণ্ডির মহাজনদের বিবেকের অভাবই ইহাতে সূচিত হইতেছে। কিন্তু পাট উৎপাদনকারী কৃষকেরা আজ যে দুর্গতি ভোগ করিতেছে, ভারতের জনসাধারণ দিনের পর দিন জীবনের আরম্ভ হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সেই দুর্গতি ভোগ করে। এই অবস্থা আর বেশীদিন সহ্য করা যাইতে পারে না, এবং এতদিন যে সহা করা হইয়াছে, ইহা ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে সুনাম নহে। ভারতের অধিবাসীরা এইভাবে