পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৩১

বাহিরে তাঁহাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্বন্ধ ছিল না, সেস্থলে তাঁহারা যেন আমাদের অপরিচিত ছিলেন।

 হেয়ার স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মুখভঙ্গী করিতেন। তাঁহার অট্টহাস্য ও মুখভঙ্গী, আমাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করিত। তাঁহার বিশাল বলিষ্ঠ দেহ, ঘন গুম্ফ এবং মুখাকৃতির জন্য তাঁহাকে বাঘের মত দেখাইত। সেই জন্য আমরা তাঁহার নাম দিয়াছিলাম ‘বাঘা চণ্ডী’। পক্ষান্তরে অ্যালবার্ট স্কুলে আমাদের শিক্ষকেরা শান্ত ও মধুর প্রকৃতির আদর্শস্বরূপ ছিলেন। আদর্শ শিক্ষকের যে সব গুণ থাকা উচিত, আদিত্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সে সবই ছিল। আমি যেন এখনও চোখের উপর দেখিতেছি, তাঁহার অধরে মৃদু হাস্য এবং মুখ হইতে শান্ত জ্যোতি বিকীর্ণ হইতেছে! মহেন্দ্রনাথ দাঁকেও আমরা সমান ভালবাসিতাম। ইঁহারা উভয়েই সামাজিক নির্যাতন হাসিমখে সহ্য করিয়া ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়াছিলেন। আমি এবং আমার দুই একজন সহাধ্যায়ী তাঁহাদের বাড়ীতে প্রায়ই যাইতাম এবং তাঁহাদের সঙ্গে সকল বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ করিতাম। ব্রাহ্ম সমাজের তত্ত্বসমূহ তাঁহারা আমাদের নিকট ব্যাখ্যা করিতেন; অন্য ধর্মের সঙ্গে ইহার প্রধান পার্থক্য এই যে ইহা অপৌরুষেয় নহে; ইহার প্রধান ভিত্তি প্রজ্ঞা ও বোধি (Rationalism and Intuition)। জীবনে এই আমি প্রথম Intuition বা বোধির অর্থ অনুধাবন করিতে চেষ্টা করিলাম। আদর্শ শিক্ষকের ব্যক্তিগত সংসর্গের প্রভাব কিরূপ তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম। ইহার বহুদিন পরে যখন আমি Tom Brown's School Days নামক বইখানি পড়ি, তখন আমার পুরাতন শিক্ষকের কথা মনে হইয়াছিল; রাগবী স্কুলের আর্নল্ড কেন যে ছাত্র পরম্পরাক্রমে সকলের হৃদয় জয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাহাও আমি বুঝিতে পারিয়াছিলাম।

 অর্দ্ধশতাব্দী পূর্বের কথা স্মরণ করিলে, আমি অ্যালবার্ট স্কুলের শিক্ষকদের কথা— তাঁহাদের সঙ্গে আমাদের স্নেহ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্বন্ধের কথা সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পুরস্কার বিতরণের সময় আমি অবশ্য পুরস্কার পাইলাম না, কেননা আমি বহুদিন স্কুলে অনুপস্থিত ছিলাম। কিন্তু শিক্ষকেরা ব্যাপারটি অশোভন হয় দেখিয়া পরামর্শ করিয়া আমাকে সকল বিষয়ে উৎকর্ষতার জন্য একটী বিশেষ পুরস্কার দিলেন। পর বৎসর আমি পরীক্ষায় প্রথম হইলাম এবং বহু পুস্তক পুরস্কার পাইলাম। ঐ সব পুস্তকের মধ্যে হ্যাজ্‌লিট কর্তৃক সম্পাদিত সেক্সপীয়রের সমস্ত গ্রন্থাবলী, ইয়ংয়ের Night Thoughts ও থ্যাকারের English Humorists ছিল।

 কৃষ্ণবিহারী সেন জয়পুর হইতে ফিরিয়া স্কুলের ‘রেক্টরের’ কর্তব্যভার গ্রহণ করিলেন। তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন—ইংরাজী সাহিত্যে তাঁহার প্রগাঢ় অধিকার ছিল, তবে তিনি বক্তৃতা করিতে পারিতেন না। এ বিষয়ে তাঁহার ভ্রাতা কেশবচন্দ্র সেনের তিনি বিপরীত ছিলেন। কেশবচন্দ্রের বাগ্মিতা বহু সভায় ব্রিটিশ শ্রোতৃমণ্ডলীকে পর্যন্ত বিচলিত করিয়াছিল। কৃষ্ণবিহারীর ছিল লিখিবার ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতা তিনি উত্তমরূপেই চালনা করিতে পারিতেন। তিনি “ইণ্ডিয়ান মিররের” যুগ্মসম্পাদক ছিলেন, অন্যতম সম্পাদক ছিলেন তাঁহার খুল্লতাতভ্রাতা নরেন্দ্রনাথ সেন। ‘মিররে’ যে রবিবার সংখ্যা প্রকাশিত হইত, কৃষ্ণবিহারী একাই তাহার সম্পাদক ছিলেন। এই সংখ্যায় কেবলমাত্র ধর্ম সম্বন্ধেই আলোচনা থাকিত। বস্তুতঃ ইহা ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম মুখপত্র ছিল।

 কেশবচন্দ্র এবং তাঁহার সহকর্মীদের উদ্যোগে অ্যালবার্ট হল তখন সবেমাত্র স্থাপিত হইয়াছে। হলের নীচের তলায় স্কুলের ক্লাস বসিত, উপর তলার হলে এবং রিডিং রুমের পাশের কয়েকটি ঘরেও ক্লাস বসিত। রিডিং রুমের টেবিলের উপর প্রধান প্রধান সাময়িক