ভয়ংকর লোক হইয়াছে। হংস আর ডিম্ভক নামক দুইবীর তাহার বন্ধু ছিল। এই তিনজন একত্র হইলে ত্রিভুবন জয় করিতে পারিত৷
হংস আর ডিম্ভকের ভালোবাসার কথা বড় সুন্দর। হংস নামক আর একজন লোকের মৃত্যুর কথা শুনিয়া ডিম্ভক ভাবিল, বুঝি তাহার বন্ধুই মরিয়া গিয়াছে। সেই দুঃখে সে যমুনায় ডুবিয়া প্রাণ ত্যাগ করিল। সে সংবাদ পাইয়া হংসও যমুনায় ডুবিয়া মারা গেল৷
মগধের চারিধারে বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি ও চৈত্যক নামে পাঁচটি প্রকাণ্ড পর্বত থাকাতে সৈন্য লইয়া গিয়া সে দেশ জয় করা একেবারে অসম্ভব তাহার উপরে আবার জরাসন্ধ নিজে এমন বীর আর তাহার এত সহায়। এইজন্য কৃষ্ণ বলিলেন যে, উহাকে অন্য উপায়ে মারিতে হইবে। কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুন এই তিনজন সাধারণ লোকের মতো মগধ দেশে গেলে সহজেই জরাসন্ধের দেখা পাওয়ার কথা। তখন ভীম যুদ্ধ করিয়া তাহাকে মারিবেন৷
এইরূপে পরামর্শের পর তিনজনে স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশে ইন্দ্রপ্রস্থ হইতে যাত্রা করিলেন। সেখান হইতে তাঁহারা ক্রমে কুরুজাঙ্গল দেশে, তারপর গণ্ডকী, সরযূ নদী পার হইয়া কোশলায়, সেখান হইতে মিথিলায়, মিথিলা হইতে মালয়, তারপর চমতী, গঙ্গা আর শোন পার হইয়া শেষে মগধে আসিযা উপস্থিত হইলেন। নগরের সিংহদ্বারের পাশেই একটি সুন্দর চৈত্য (জয়স্তম্ভ) আর তিনটা বিশাল দুন্দুভি (ডঙ্কা) ছিল। সেখানে আসিয়া তাঁহাদের প্রথম কাজই হইল সেই জিনিসগুলিকে চুরমার করা। তারপর তাঁহারা খুব খুশি হইয়া নগরে প্রবেশ করিলেন। রাজপথের দুইধারে ময়রা, সওদাগর, মালাকর প্রভৃতির দোকান ছিল, তাহা হইতে জোর করিয়া মালা লইয়া তাঁহারা গলায় পরিলেন! এ-সকল কাণ্ড দেখিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, না জানি ইহারা কে!
এইরূপে ক্রমে তাঁহারা জরাসন্ধের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলে জরাসন্ধ তাঁহাদিগকে স্নাতক ব্রাহ্মণ ভাবিয়া অনেক আদর-যত্ন করিল। কিন্তু ভীম আর অর্জুন তাহার কোনো কথার উত্তর দিলেন না। কৃষ্ণ বলিলেন, “ইহাঁদের নিয়ম আছে, এখন কথা কহিবেন না। দুই প্রহর রাত্রির সময় আপনার সহিত ইহাদের কথাবার্তা হইবে৷”
রাত্রি দুই প্রহরের সময় জরাসন্ধের সহিত কথাবার্তা আরম্ভ হইলে জরাসন্ধ বলিল, “আপনাদের পোশাক স্নাতক ব্রাহ্মণের মতো। কিন্তু স্নাতক ব্রাহ্মণেরা তো এমন সময়ে মালা-চন্দন পরেন না। আপনাদের হাতে ধনুর্গুণের দাগ দেখিয়া ক্ষত্রিয় বলিয়াই বোধ হয়। অথচ আপনারা ব্রাহ্মণের বেশে আসিয়াছেন, আবার চৈত্যটি ভাঙিয়াছেন! আমি আদর-যত্ন করিলাম তাহারও আপনারা ভালো করিয়া উত্তর দেন নাই! যাহা হউক, আপনারা কিজন্য আসিয়াছেন?”
কৃষ্ণ বলিলেন, “স্নাতক তো ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যেরাও হইতে পারে, আমাদিগকে ব্রাহ্মণ মনে করিবার প্রয়োজন কি? মালা পরিলে দেখায় ভালো, তাই আমরা মালা পরিয়াছি। গায়ের জোর দেখানো ক্ষত্রিয়ের উচিত কাজ, তাই কিছু দেখাইয়াছি, আপনার দেখিবার ইচ্ছা থাকিলে আজই আরো ভালো করিয়া দেখিতে পাইবেন। শত্রুর ঘরে আসিয়া তাহার নিকট হইতে আদর লওয়া আমরা ভালো মনে করি না, তাই আপনার আদর-যত্নের উত্তর দেই নাই৷”