পাতা:উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র.djvu/২৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ছেলেদের মহাভারত
২৬৯

অর্জুন এমনি ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে, তাহাকে আটকান দূরে থাকুক, উহাদের নিজের প্রাণ বাঁচানোই ভার হইল। চারিদিকে খালি যোদ্ধাদের মাথা কাটিয়া পড়িতেছে, ইহা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া, ভীষ্ম তাড়াতাড়ি দ্রোণাচার্যকে ডাকিয়া বলিলেন, “ঐ দেখ, অর্জুন কি আরম্ভ করিয়াছে! আজ আর উহার সঙ্গে পারা যাইবে না। বেলাও শেষ হইয়াছে শীঘ্র যুদ্ধ থামাইয়া দাও।”

 কাজেই তখন যুদ্ধ শেষের শিঙ্গা বাজিয়া উঠিল; কৌরব সৈন্যেরাও বলিল, “আঃ বাঁচিলাম!”

 পরদিন কৌরবেরা গরুড় ও পাণ্ডবেরা অর্ধচন্দ্র’ ব্যুহ করিয়া সৈন্য সাজাইলেন। সেদিন ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, দ্রৌপদীর পাচ পুত্র, ভীম, ঘটোৎকচ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব প্রভৃতি সকলেই খুব যুদ্ধ করেন। যুধিষ্ঠির আর ধৃষ্টদ্যুম্ন এমনি যুদ্ধ করিয়াছিলেন যে, ভীষ্ম আর দ্রোণ দুজনে মিলিয়াও তাহাদিগকে নিবারণ করিতে পারেন নাই। কৌরব-সৈন্যেরা ভীষ্ম দ্রোণের কথা না শুনিয়া তাহাদের সম্মুখে পলাইতে লাগিল।

 ইহা দেখিয়া দুর্যোধন ভীষ্মকে বলিলেন, “সৈন্য সব মারা যাইতেছে, আর আপনারা চুপ করিয়া আছেন! ইহাতে বোধহয়, পাণ্ডবদের উপকার করাই আপনাদের উদ্দেশ্য। এমন জানিলে আমি কখনোই যুদ্ধ করিতে আসিতাম না।”

 এ কথায় ভীষ্ম বলিলেন, “পাণ্ডবেরা যে কত বড় বীর, তাহা তোমাকে বারবার বলিয়াছি। আমি বুড়া মানুষ, তথাপি আমার যথাসাধ্য যুদ্ধ করিতেছি, দেখ।”

 এই বলিয়া ভীষ্ম ক্রোধভরে এমনি যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন যে কাহার সাধ্য তাহার সামনে দাঁড়ায়! চারিদিকে কেবল হায় হায়!’ রক্ষা কর?’ বাবা গো!’ এইরূপ শব্দ। পাণ্ডব পক্ষের এক এক যোদ্ধার নাম করিয়া তিনি বলেন, “এই তোমাকে কাটলাম!” আর অমনি তাহার মাথা কাটিয়া পড়ে! সেই বুড়ো মানুষ তখন এমনি বেগের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন যে, তাহার বাণই কেবল দেখা গিয়াছিল, কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

 এইরূপ অবস্থা দেখিয়া কৃষ্ণ অর্জুনকে বলিলেন, “অর্জুন! এই তো সময়। তুমি বলিয়াছিলে ভীষ্ম, দ্রোণ সকলকে মারিবে; এখন তোমার কথা রাখ।”

 অর্জুন বলিলেন, “শীঘ্র ভীষ্মের নিকট রথ লইয়া চলুন।”

 কিন্তু অর্জুন অনেক যুদ্ধ করিয়াও ভীষ্মকে পরাজয় করিতে পারিলেন না। বুড়া বাণে বাণে কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া হাসিতে লাগিলেন। কৃষ্ণ বলিয়াছিলেন যুদ্ধ করিবেন না; কিন্তু ভীষ্মের কাণ্ড দেখিয়া তাহার মনে হইল যে, চুপ করিয়া থাকিলে বা তিনি এখনই পাণ্ডবদিগের সকলকে মারিয়া শেষ করেন। কাজেই তিনি রাগে অস্থির হইয়া বলিলেন, “আজই আমি কৌরবদিগের সকলকে মারিয়া যুধিষ্ঠিরকে রাজা করিব।”

 এই বলিয়া তিনি তাহার সেই সুদর্শন চক্র নামক আশ্চর্য অস্ত্র হাতে ভীষ্মকে মারিবার জন্য ছুটিয়া চলিলেন। ভীষ্মের তাহাতে কিছুমাত্র ভয় বা দুঃখের চিহ্ন দেখা গেল না। তিনি কৃষ্ণকে নমস্কার করিয়া বলিলেন, “তুমি সকল দেবতার শ্রেষ্ঠ, তোমার হাতে মরিলে তো আমি অমনি স্বর্গে যাই। এখনই আমাকে কাট।”

 এমন সময় অর্জুন নিতান্ত লজ্জিত ও কাতরভাবে আসিয়া কৃষ্ণের পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “আপনি শান্ত হউন, আমি আর যুদ্ধে অবহেলা করিব না।”