পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

স্তরে যে একটা বিষাদের আস্তরণ ছিল, তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাতে বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল। আমার আবরণ খসিয়া পড়িল, মনে হইল সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখিলাম, মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখিলাম।”

 ঘটনাটি যে তাঁহার জীবনেই জন্মান্তর ঘটাইয়াছে, ইহা রবীন্দ্রনাথ গোপন করেন নাই। তাই আশি বছরের আয়ূর প্রান্তে উপনীত হইয়া পিছনের সমগ্র জীবনকে দেখিতে গিয়া এই ঘটনাটিই তিনি একান্তভাবে আপন দৃষ্টিতে গ্রহণ করিয়াছেন। আঠারো-ঊনিশ বছরের ঘটনাটি সম্বন্ধে আশি বছরে আসিয়া তিনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিয়াছেন, “সেই একদিন তখন বালক ছিলাম—জানিনে কোন্, উদয়পথ দিয়ে প্রভাতসূর্যের আলোক এসে সমস্ত মানব সম্বন্ধকে আমার কাছে অকস্মাৎ আত্মার জ্যোতিতে দীপ্তিমান করে দেখিয়েছিল।”

 এই উপলব্ধিটিকে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, — ‘সত্যকে দেখা’, ‘অন্তরাত্মাকে দেখা’। কিন্তু ইহাই যে প্রকৃত সত্যসাক্ষাৎকার বা আত্মদর্শন, তার প্রমাণ কি ? প্রশ্নের উত্তর দিবার পূর্বে জানা দরকার যে, আত্মদর্শন কি।

 মহর্ষি পতঞ্জলি যোগসূত্রে আত্মদর্শন বা আত্মজ্ঞানকে বলিয়াছেন, ‘প্রসংখ্যান অর্থাৎ প্রকৃতি হইতে পুরুষ পৃথক, এই দর্শন বা বিবেকজ্ঞান। এই 'প্রসংখ্যান’-বান্ পুরুষকেই পর্বোদ্ধৃত সূত্রে তিনি বলিয়াছেন, ‘বিশেষদর্শী’। চিত্ত হইতে চৈতন্যকে যিনি পৃথক রূপে দেখিয়াছেন, তিনিই এই ‘বিশেষদর্শী’। এই ‘বিশেষদর্শন'টিই যে রবীন্দ্রনাথের হইয়াছে, তাঁহার প্রথম উপলব্ধিতেই সে সম্পর্কে প্রমাণ রহিয়াছে। এই বিশেষদর্শন হইয়াছিল বলিয়াই রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির বর্ণনায় আমরা দেখিতে পাই—‘আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আস্তরণ ছিল তাহা এক নিমিষেই ভেদ করিয়া বিশ্বের আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল।”

 এখানে নিজের অন্তঃকরণকে বা হৃদয়কে দেখার কথা আছে, আর যে আলোতে তাহা দেখিয়াছেন, তাহার কথাও আছে। অন্তঃকরণকে দেখা মানেই মহর্ষি পতঞ্জলির কথিত ‘চিত্ত’কে দেখা; আর, ‘বিশ্বের আলোক’ বলিতে ‘চৈতন্য’কেই রবীন্দ্রনাথ বুঝাইয়াছেন। আশি বছরের পরিণত অবস্থায় এই ঘটনা সম্বন্ধে তাই তিনি একেবারে স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছেন দেখা যায়,—‘আত্মার জ্যোতিতে দীপ্তিমান করে দেখিয়েছিল।’


 যেটুকু সামান্য বিশ্লেষণ করা হইল, তাহাতে জানা গেল যে, মহর্ষি পতঞ্জলির