পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

যোগসূত্রের বিচারে রবীন্দ্রনাথ ‘বিশেষদর্শী’, অর্থাৎ ‘চিত্ত হইতে চৈতন্যকে পৃথকরূপে’ তিনি দেখিয়াছেন। যোগসূত্রের ভাষ্যে ব্যাসদেব এই দেখাকেই বলিয়াছেন— ‘আত্মসাক্ষাৎকার’। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই উপলব্ধিকে বুঝাইতে গিয়া বলিয়াছেন,—“সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখিলাম, মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখিলাম।” আত্মসাক্ষাৎকারের যে বীজের কথা ব্যাসভাষ্যে বলা হইয়াছে এবং যাহা লইয়াই রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, এই উপলব্ধিটি রবীন্দ্রনাথের জীবনে সেই ব্রহ্মবীজেরই প্রথম ফলরূপ প্রকাশ।

 ঘটনাটির বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ ইহাও বলিয়াছেন, “এক মুহূর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল।”

 কথাটির অর্থ কি? অর্থ বুঝিতে হইলে উপনিষদের একটু সাহায্য লইতে হইবে।

 উপনিষদ বলেন,—“ঈশাবাস্যং সর্বমিদং”—এই জগতের সর্বকিছুই ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত, অথবা এই জগতের সবকিছুতেই ঈশ্বর বাস করেন (তিনি বাস করেন বলিয়াই বস্তুকে বলা হয় ‘বস্তু’)॥

 কিন্তু আমরা সব কিছুকেই দেখি, যিনি ইহাদিগকে আচ্ছাদিত করিয়া আছেন, কিম্বা যিনি ইহাদের অন্তরে বা আড়ালে আছেন, তাঁহাকে কখনো আমরা দেখি না। কেন? উপনিষদ বলেন, “আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে”— এই সমস্ত ভূতজগৎ আনন্দ হইতে জাত, আনন্দে স্থিত এবং পরিণামে আনন্দেই অবসিত।

 কিন্তু আমরা ভূত-জগতকেই দেখি, ‘সেই আনন্দ’—কে দেখি না। কেন? উপনিষদ বলেন,—

 “সূর্য-চন্দ্র-অগ্নি-বিদ্যুৎ কেহই তাঁহাকে প্রকাশ করে না, “তবেমভান্তং অনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি।”—তিনি প্রকাশমান বলিয়াই সবকিছু প্রকাশমান, তাঁহারই জ্যোতিতে এই সবকিছু প্রকাশিত ॥

 কিন্তু আমরা প্রকাশমান জগতকেই দেখিতেছি, যে-জ্যোতিতে তাহা প্রকাশিত, তাহাকে দেখি না। কেন?

 নিশ্চয় কোথাও কোন পর্দা, আবরণ, আচ্ছাদন কিছু রহিয়াছে, তাই ঈশাবাস্যং সর্বমিদং-এর ঈশকে দেখি না; খল্বিমানি ভূতানি যে-আনন্দ হইতে জাত, সে-আনন্দকে দেখি না; যে-জ্যোতি সর্বকিছু প্রকাশক, সেই জ্যোতিকে দেখি না। অদৃশ্য এক আবরণ নিশ্চয় রহিয়াছে, তাই জগতের নামরূপই দৃষ্ট হইয়া থাকে, সে