বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
১১

যে ‘সদায়তন’ তাহা আমরা দেখি না; নামরূপের প্রকাশই শুধু আমরা দেখি, তাহার ‘অস্তি-ভাতি-প্রিয়’ (সৎচিৎ-আনন্দ) রূপটি আমরা এই আবরণের জন্যই দেখি না।

 কি সে আবরণ, যাহাতে আমাদের আত্মা আমাদের দৃষ্টিতেই আবৃত বা অদৃশ্য? কি সে আচ্ছাদন, যাহাতে এই জগতের অন্তর্যামী ব্রহ্ম জগতের দৃষ্টি হইতেই গোপন বা অদৃশ্য? উপনিষদ সেই আবরণ বা আচ্ছাদনকেই বলিয়াছেন ‘অবিদ্যা’ বা ‘তমসা’।

 এই অবিদ্যা বা তমসা কাহাকে আবৃত করিতেছে? জগৎ অনাবৃত নিত্যপ্রকাশিত, এখানে কোন আবরণই নাই। আর, ব্রহ্মকে আবৃত করিবে, এতবড় তমসা বা অবিদ্যা কোথায়? ব্রহ্ম যিনি বৃহৎ, যিনি পূর্ণ, যিনি ভূমা, তাঁহাকে যেমন কেহ প্রকাশিত করিতে পারে না তেমনি তাঁহাকে কেহ আবৃতও করিতে পারে না। উপনিষদ বলেন, এই অবিদ্যায় আমরাই আচ্ছাদিত, এই তমসায় আমরাই আবৃত। এই জন্যই উপনিষদের ঋষির প্রার্থনা সরাও আমার এই আবরণ, সরাও সর্বগ্রাসী আমার এই তমসা, দেখাও তোমার সেই জ্যোতিষাং জ্যোতি।

 উপনিষদের এই তত্ত্বই রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত উপলব্ধিতে অভিব্যক্ত হইয়াছে। এই অবিদ্যা-আবরণ অপসৃত হইয়াছিল বলিয়াই তিনি বলিতে পারিয়াছেন—“হঠাৎ এক মুহূর্তে আমার চোখের উপর হইতে যেন একটা পর্দা সরিয়া গেল।”

 পর্দা সরিয়া গিয়াছিল, কাজেই এতদিনের অভ্যস্ত চোখদিয়া-দেখার পরিবর্তে একেবারে চৈতন্য দিয়াই দেখার সুযোগ তিনি পাইয়াছেন। সেই চৈতন্যদিয়া দেখাটাকেই তিনি এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেন—“দেখিলাম এক অপরূপ মহিমায় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন”।

 ইহাই উপনিষদের সেই ‘ঈশাবাস্য সর্বমিদং’ দেখা। চৈতন্য দিয়া দেখিয়াছেন বলিয়াই রবীন্দ্রনাথ বলিতে পারিয়ছেন—“দেখিলাম আনন্দে ও সৌন্দর্যে সর্বত্রই তরঙ্গিত।” ইহাই উপনিষদের সেই “আনন্দ ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ”। ইহাই তো উপনিষদের সেই ‘রস বৈ সঃ’-এর রূপকে দেখা।

 দৃষ্টির আবরণ সরিয়া গেলে শুধু কি জগতেরই সত্যরূপ উদ্ঘাটিত হয়? নিজের স্বরূপ কি তখনো আবৃত থাকে? না, উপনিষদ বলেন, তখন জীব ও জগৎ, অন্তর ও বাহির দুইয়েরই সত্যরূপ অনাবৃত হয়।

 রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতেও তাই দেখিতে পাওয়া যায় যে, ‘হৃদয়ের আস্তরণ ভেদ’ হইবার কথা আছে। হৃদয়ের আবরণ ভেদ হইলে কি দেখা যায়? রবীন্দ্রনাথ