পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ
৪৯

দৃশ্যের দিকে, সে-দিকে ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ পাওয়া যায় নাই। সেতুর যে-মুখটা দ্রষ্টার দিকে, সে-পথে হয়তো ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া গেলেও যাইতে পারে। কাজেই সেতুর এই দিকটার একটু খোঁজ লওয়া যাইতেছে।

 কোন ইন্দ্রিয়ই তাহার কর্তাকে বা দ্রষ্টাকে দেখে না, যদিও ইন্দ্রিয় কর্তারই নিজস্ব শক্তি। ইন্দ্রিয়ের এই পারটা চিরকালই অজ্ঞেয় বা দুর্জ্ঞেয়। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করিবার যে, ইন্দ্রিয়ের যে সেতু-মুখ দৃশ্যের দিকে নিবদ্ধ, তাহা কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে চির-লগ্ন নহে; অর্থাৎ, নিদ্রা-মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় দৃশ্য হইতে ইন্দ্রিয়ের সেতুমখ উত্তোলিত বা বিযুক্ত হয়। কিন্তু দ্রষ্টা হইতে দৃষ্টিশক্তি অর্থাৎ ইন্দ্রিয় কখনো বিযুক্ত হইতে পারে না, কারণ শক্তি কখনো শক্তিমানকে বা তাহার আশ্রয়কে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না।

 দৃশ্যের দিকে ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া যায় নাই, কাজেই দ্রষ্টার দিকেই ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া যাইবে, যদি রবীন্দ্রনাথের কথিত কোন ‘পার’ আদৌ থাকে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে এদিকেই ইঙ্গিত করিয়াছেন, ইহা ধরিয়া লইয়া এখন আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হইবে।

 ইন্দ্রিয়ের এ-মুখে কাহাকে পাওয়া যায়? ইন্দ্রিয়ের কর্তাকে বা দ্রষ্টাকে, বা সাক্ষীকে। আর, আসল দ্রষ্টা বা সাক্ষী বলিতে আত্মাকেই বুঝাইয়া থাকে এবং সেই আত্মাই ব্রহ্ম, ইহাই উপনিষদের উপদেশ। ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’—রূপে ব্রহ্মেরই সন্ধান রবীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ পাইয়াছেন বলিয়া জানাইয়াছেন। ইন্দ্রিয়ের এইদিকেই যখন ব্রহ্ম রহিয়াছেন, তখন ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে রবীন্দ্রনাথ দ্রষ্টার দিকেই ইঙ্গিত করিয়াছেন, ইহাই এখন সিদ্ধান্ত।

 উপনিষদে এই সিদ্ধান্তেরই সমর্থন পাওয়া যাইবে। কঠোপনিষদের একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে—

 “স্বয়ম্ভূ ইন্দ্রিয়সমূহকে বহির্মুখ করিয়াছেন, সেইজন্য জীবগণ বহির্বিষয় দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে দেখিতে পায় না। কোন ধীর ব্যক্তি অমৃতত্ব-অভিলাষে ‘আবৃত-চক্ষু’ হইয়া আত্মাকে দর্শন করে॥”

 এখানে পরিষ্কার বলা হইয়াছে যে, ইন্দ্রিয়গণ স্বভাবে বহির্মুখ এবং বহির্মুখ ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে ব্রহ্ম প্রকাশিত হন না।

 আর বলা হইয়াছে যে, ধীর বিবেকী ব্যক্তি, ‘আবৃতচক্ষু হইয়া’ অর্থাৎ বহির্মুখ ইন্দ্রিয়কে বহির্বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া তবে ব্রহ্মকে দর্শন করেন।