পাতা:ঋষি রবীন্দ্রনাথ - অমলেন্দু দাশগুপ্ত (১৯৫৪).pdf/৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫৮
ঋষি রবীন্দ্রনাথ

পরমব্রহ্মকে ধর্মহীন প্রজ্জ্ব্লিত অনল-শিখার ন্যায় হৃদয়মধ্যে দর্শন করিয়া থাকেন॥”

 বেদব্যাস দেহমধ্যস্থ ব্রহ্মজ্যোতিকে বলিয়াছেন, “ধর্মহীন প্রজ্জ্বলিত অনলশিখা,” আর রবীন্দ্রনাথ দেহমধ্যস্থ সেই জ্যোতিকেই বলিয়াছেন, “অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা।”—উভয় বর্ণনার সাদৃশ্য এত স্পষ্ট যে, বিশেষ ব্যাখ্যার আবশ্যক করে না।

 এই একই উপদেশ ব্যাসদেব অন্যত্র বলিয়াছেন, “ব্রহ্মবিদ মহাত্মারাই সেই সর্বব্যাপী বিধূম পাবকের ন্যায় পরমব্রহ্মকে দর্শন করেন॥”

 পুনরাবৃত্তি করা যাইতে পারে যে, ‘ব্যাসদেবের ধর্মহীন প্রজ্জ্বলিত অনলশিখা’ এবং রবীন্দ্রনাথের “অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা” শব্দ এবং অর্থ উভয়গত ভাবেই একই বস্তু বা একই ব্রহ্মজ্যোতির নির্দেশ করিয়া থাকে।

 মহাভারতে মহর্ষি বশিষ্ঠের যে উপদেশ লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তাহার একস্থানে বলা হইয়াছে—“আত্মা প্রকাশিত হইলে হৃদয়মধ্যে বিধূম পাবকের ন্যায়, রশ্মিযুক্ত দিবাকরের ন্যায় এবং বিদ্যুৎ-সম্বন্ধীয় অগ্নির ন্যায় লক্ষিত হইয়া থাকেন॥”

 বশিষ্ঠদেবের বর্ণিত আত্মদর্শন এবং রবীন্দ্রনাথের কথিত দর্শন—এই দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?

 মহাভারত হইতে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য, ভৃগু, ব্যাসদেব এবং বশিষ্ঠদেবের যে উপদেশ কয়টি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহাতে একবাক্যে এই সত্যই কথিত হইয়াছে যে, এই দেহেই ব্রহ্মের জ্যোতিরূপটি পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে। এই জ্যোতি বা বিধূম পাবকশিখা আর রবীন্দ্রনাথের ‘দীপ্তিময়ী শিখা’ এক বলিয়াই আমরা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছি।

 রবীন্দ্রনাথ প্রথমে বলিয়াছেন, তিনি ভূমাকে ধ্যানচোখে দেখিয়াছেন। তারপর তিনি বলিয়াছেন, ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’-কে তিনি ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ দেখিয়াছেন এবং এই দুইটি দর্শনে ব্রহ্মই লক্ষিত হইয়াছেন, ইহাও আমরা দেখিয়াছি। ইহার পরেই রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন,—অনির্বাণ দীপ্তিময়ীশিখাকে দেহমধ্যে তিনি দেখিয়াছেন। শাস্ত্রীয় প্রমাণ ব্যতীতই এবং স্বতই বুঝা যায় যে, এক্ষেত্রেও তিনি ব্রহ্ম-দর্শনের কথাই বলিয়াছেন। উপরন্তু, যোগাদিশাস্ত্র এবং মহাভারতের প্রমাণ হইতেও আমরা দেখিয়াছি যে, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্ট এই “অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা” ব্রহ্মেরই প্রকাশিত জ্যোতিরূপ। কাজেই আমরা এখন ঘোষণা করিতে পারি—রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি।