পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 8ළුණූ শুভদৃষ্টি কান্তিচন্দ্রের বয়স অলপ, তথাপি সন্ত্রীবিয়োগের পর দ্বিতীয় স্ত্রীর অনুসন্ধানে ক্ষান্ত থাকিয়া পশুপক্ষী-শিকারেই মনোনিবেশ করিয়াছেন। দীর্ঘ কৃশ কঠিন লঘ শরীর, তীক্ষ দৃষ্টি, অব্যথা লক্ষ্য, সাজসজায় পশ্চিমদেশীর মতো; সঙ্গে সঙ্গে কুস্তিগির হীরা সিং, ছক্কনলাল, এবং গাইয়ে বাজিয়ে খসিাহেব, মিঞাসাহেব অনেক ফিরিয়া থাকে; অকমণ্য অনচের-পরিচরেরও অভাব নাই। দইচারিজন শিকারী বন্ধবোন্ধব লইয়া আল্লানের মাঝামাঝি কান্তিচন্দ্র নৈদিঘির বিলের ধারে শিকার করিতে গিয়াছেন। নদীতে দুইটি বড়ো বোটে তাঁহাদের বাস, আরও গোটা-তিনচার নৌকায় চাকরবাকরের দল গ্রামের ঘাট ঘিরিয়া বসিয়া আছে। গ্রামবধদের জল তোলা, স্নান করা প্রায় বন্ধ । সমস্ত দিন বন্দকের আওয়াজে জলস্থল কম্পমান, সন্ধ্যাবেলায় ওস্তাদি গলার তানকতবে পল্লীর নিদাতলদা তিরোহিত । একদিন সকালে কান্তিচন্দ্র বোটে বসিয়া বন্দকের চোঙ সযত্নে স্বহস্তে পরিকার করিতেছেন, এমনসময় অনতিদারে হাঁসের ডাক শুনিয়া চাহিয়া দেখিলেন, একটি বালিকা দই হাতে দুইটি তরণে হাঁস বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া ঘাটে আনিয়াছে। নদীটি ছোটো, প্রায় স্রোতহীন, নানাজাতীয় শৈবালে ভরা। বালিকা হাঁস দুইটিকে জলে ছাড়িয়া দিয়া, একেবারে আয়ত্তের বাহিরে না যায় এইভাবে, ত্রস্তসতক স্নেহে তাহাদের আগলাইবার চেষ্টা করিতেছে। এটুকু বুঝা গেল, অন্য দিন সে তাহার হাঁস জলে ছাড়িয়া দিয়া চলিয়া যাইত, কিন্তু সম্প্রতি শিকারীর ভয়ে নিশ্চিন্তচিত্তে রাখিয়া যাইতে পারিতেছে না। মেয়েটির সৌন্দৰ্য নিরতিশয় নবীন, যেন বিশ্বকমা তাহাকে সদ্য নিমাণ করিয়া ছাড়িয়া দিয়াছেন। বয়স ঠিক করা শক্ত। শরীরটি বিকশিত কিন্তু মুখটি এমন কাঁচা যে, সংসার কোথাও যেন তাহাকে লেশমাত্র সপশ করে নাই। সে যে যৌবনে পা ফেলিয়াছে এখনও নিজের কাছে সে খবরটি তাহার পৌছে নাই। কান্তিচন্দ্র ক্ষণকালের জন্য বন্দকে সাফ করার ঢিল দিলেন। তাঁহার চমক লাগিয়া গেল। এমন জায়গায় এমন মুখ দেখিবেন বলিয়া কখনও আশা করেন নাই। অথচ, রাজার অন্তঃপরের চেয়ে এই জায়গাতেই এই মুখখানি মানাইয়াছিল। সোনার ফলেদানির চেয়ে গাছেই ফলকে সাজে। সেদিন শরতের শিশিরে এবং প্রভাতের রৌদ্রে নদীতীরের বিকশিত কাশবনটি ঝলমল করিতেছিল, তাহারই মধ্যে সেই সরল নবীন মুখখানি কান্তিচন্দ্রের মন্ধে চক্ষে আশিবনের আসন্ন আগমনীর একটি আনন্দচ্ছবি অকিয়া দিল। মন্দাকিনীতীরে তরণ পাবতী কখনও কখনও এমন হংসশিশ বক্ষে লইয়া আসিতেন, কালিদাস সে কথা লিখিতে ভুলিয়াছেন। এমনসময় হঠাৎ মেয়েটি ভীতন্ত্রস্ত হইয়া কাঁদো-কাদো মুখে তাড়াতাড়ি হাঁস দটিকে বকে তুলিয়া লইয়া অব্যক্ত আত্মবরে ঘাট ত্যাগ করিয়া চলিল। কান্তিচন্দ্র কারণসন্ধানে বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার একটি রসিক পারিষদ কৌতুক করিয়া বালিকাকে ভয় দেখাইবার জন্য হাঁসের দিকে ফাঁকা বন্দকে লক্ষ্য করিতেছে। কান্তিচন্দ্র পশ্চাৎ হইতে বন্দকে কাড়িয়া লইয়া হঠাৎ তাহার গালে সশঙ্গে প্রকাণ্ড একটি চপেটাঘাত