পাতা:গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাসমণির ছেলে ●O○ তাহার এই নোট লইয়া গিয়াছে। চোরে চুরি করিলেও তাহার মনে এত বাজিত না। তাহার মনে হইতে লাগিল, যেন ধনমদগবিত যবেকেরা তাহার মায়ের গায়ে হাত তুলিয়াছে। এতদিন কালীপদ এই মেসে আছে, এই সিড়িটুকু বাহিয়া একদিনও সে উপরের তলায় পদাপণও করে নাই। আজ— তাহার গায়ে সেই ছোড়া গেঞ্জি, পায়ে জতা নাই, মনের আবেগে এবং মাথা ধরার উত্তেজনায় তাহার মখে লাল হইয়া উঠিয়াছে— সবেগে সে উপরে উঠিয়া পড়িল । আজ রবিবার— কলেজে যাইবার উপসর্গ ছিল না, কাঠের ছাদ-ওয়ালা বারান্দায় বন্ধগণ কেহ বা চৌকিতে, কেহ বা বেতের মোড়ায় বসিয়া, হাস্যালাপ করিতেছিল। কালীপদ তাহাদের মাঝখানে ছটিয়া পড়িয়া ক্লোধগদগদ বরে বলিয়া উঠিল, “দিন, আমার নোট দিন ।” যদি সে মিনতির সরে বলিত তবে ফল পাইত সন্দেহ নাই। কিন্তু, উন্মত্তবৎ কম্পমতি দেখিয়া শৈলেন অত্যন্ত থাপা হইয়া উঠিল। যদি তাহার বাড়ির দারোয়ান থাকিত তবে তাহাকে দিয়া এই অসভ্যকে কান ধরিয়া দরে করিয়া দিত, সন্দেহ নাই । সকলেই দাঁড়াইয়া উঠিয়া একত্রে গঞ্জ’ন করিয়া উঠিল, “কী বলেন, মশায় ! কিসের নোট ।” কালীপদ কহিল, “আমার বাক্স থেকে আপনারা নোট নিয়ে এসেছেন।” “এত বড়ো কথা । আমাদের চোর বলতে চান ?” কালীপদর হাতে যদি কিছু থাকিত তবে সেই মহেতেই সে খনোখনি করিয়া ফেলিত । তাহার রকম দেখিয়া চার-পাঁচ জনে মিলিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল। সে জালবদ্ধ বাঘের মতো গমেরাইতে লাগিল। এই অন্যায়ের প্রতিকার করিবার তাহার কোনো শক্তি নাই, কোনো প্রমাণ নাই— সকলেই তাহর সন্দেহকে উন্মত্ততা বলিয়া উড়াইয দিবে। যাহারা তাহাকে মাতুব্বাণ মবিয়াছে তাহার। তাহার ঔদ্ধতাকে অসহা বলিয়া বিষম আসফালন করিতে লাগিল । সে রাত্রি যে কালীপদর কেমন করিয়া কাটিল তাহা কেহ জানিতে পারিল না। শৈলেন একখানা এক-শো টাকার নোট বাহির করিয়া বলিল, “দাও, বাঙালটাকে দিয়ে এসে গে যাও ।” সহচররা কহিল, "পাগল হয়েছ ; তেজটকু আগে মরকে— আমাদের সকলের কাছ একটা রিটন অ্যাপলক্তি আগে দিক, তার পরে বিবেচনা করে দেখা যাবে।” যথাসময়ে সকলে শাইতে গেল এবং ঘামাইয়া পড়িতেও কাহারও বিলম্ব হইল না। সকলে কালীপদব কথা প্রায সকলে ভুলিয়াই গিয়াছিল। সকালে কেহ কেহ সিড়ি দিয়া নীচে নামিবার সময় তাহার ঘর হইতে কথা শুনিতে পাইল। ভাবিল, হয়তো উকিল ডাকিয়া পরামশ করিতেছে। দরজা ভিতর হইতে খিল-লাগানো। বাহিরে কান পাতিয়া যাহা শুনিল তাহার মধ্যে আইনের কোনো সংস্রব নাই, সমস্ত অসম্মবন্ধ প্রমাপ । উপরে গিয়া শৈলেনকে খবর দিল। শৈলেন নামিয়া আসিয়া দরজার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল । কালীপদ কণী-যে বকিতেছে ভালো বোঝা যাইতেছে না, কেবল ক্ষণে ক্ষণে বাবা বাবা করিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। ভয় হইল, হয়তো সে নোটের শোকে পাগল হইয়া গিয়াছে। বাহির হইতে দই