পাতা:ঘরে-বাইরে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০১৯).pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ঘরে-বাইরে
১৪৭

টাকা নিচ্ছেন, এই ছিল আমার নালিশ। তাঁদের স্বামীদের মৃত্যুর পরে অনেক সরকারি জিনিসপত্র তাঁরা লুকিয়ে সরিয়েছেন, এ কথা অনেকবার আমার স্বামীকে বলেছি। তিনি তাঁর কোনাে জবাব না করে চুপ করে থাকতেন। তখন আমার রাগ হত; আমি বলতুম, দান করতে হয় হাত তুলে দান করাে, কিন্তু চুরি করতে দেবে কেন? বিধাতা সেদিন আমার এই নালিশ শুনে মুচকে হেসেছিলেন। আজ আমি আমার স্বামীর সিন্দুক থেকে ঐ বড়ােরানীর মেজোরানীর টাকা চুরি করতে চলেছি।

 রাত্রে আমার স্বামী সেই ঘরেই তাঁর কাপড় ছাড়েন, সেই কাপড়ের পকেটেই তাঁর চাবি থাকে। সেই চাবি বের করে নিয়ে লােহার সিন্দুক খুললুম। অল্প যে একটু শব্দ হল, মনে হল, সমস্ত পৃথিবী যেন জেগে উঠল। হঠাৎ একটা শীতে আমার হাত পা হিম হয়ে বুকের মধ্যে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগল।

 লােহার সিন্দুকের মধ্যে একটা টানা দেরাজ আছে। সেইটে খুলে দেখলুম, নােট নেই, কাগজের মােড়কে ভাগ করা গিনি সাজানাে। প্রতি মােড়কে কত গিনি আছে, আমার কত দরকার, সে তখন হিসেব করবার সময় নয়। কুড়িটি মােড়ক ছিল, সব-কটা নিয়েই আমার আঁচলে বাঁধলুম।

 কম ভারী নয়। চুরির ভারে আমার মন যেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হয়তাে নােটের তাড়া হলে সেটাকে এত বেশি চুরি বলে মনে হত না। এ যে সব সােনা!

 সেই রাত্রে নিজের ঘরে যখন চোর হয়ে ঢুকতে হল তখন থেকে এ ঘর আমার আর আপন রইল না। এ ঘরে আমার কত বড়াে অধিকার— চুরি করে সব খােওয়ালুম।

 মনে মনে জপতে লাগলুম, বন্দে মাতরং! বন্দে মাতরং! দেশ, আমার দেশ! আমার সােনার দেশ! সব সােনা এই দেশের সােনা, এ আর-কারাে নয়।

 কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে মন যে দুর্বল হয়ে থাকে। স্বামী পাশের ঘরে ঘুমােচ্ছিলেন, চোখ বুজে তাঁর ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেলুম—অন্তঃপুরের খােলা ছাদের উপর দিয়ে সেই আঁচলে-বাঁধা চুরির উপর বুক দিয়ে মাটিতে পড়ে রইলুম— সেই মােড়কগুলাে বুকে বাজতে লাগল। নিস্তব্ধ রাত্রি আমার শিয়রের কাছে তর্জনী তুলে রইল। ঘরকে তাে আমি দেশ থেকে স্বতন্ত্র করে দেখতে পারলুম না। আজ ঘরকে লুটেছি, দেশকেই লুটেছি— এই পাপে একই সঙ্গে ঘর আমার ঘর রইল না, দেশও হয়ে গেল