পাতা:ছিন্নমুকুল - স্বর্ণকুমারী দেবী.pdf/১০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিংশ পরিচ্ছেদ
১০১

 “সন্ন্যাসীর যে আমাদের উপরে আর সন্দেহ নেই তাতে আমার মনের একটা মস্ত বোঝা নেমে গেছে।”

 যামিনী তাঁহাকে যে সংবাদ দিবার অবসর খুঁজিতেছিলেন এই কথায় তাহার সুযোগ বুঝিয়া বলিলেন—

 “হাঁ, ভাই তোমাকে এতক্ষণ একটা কথা বলা হয় নি। সন্ন্যাসী আমার প্রত্যুপকার স্বরূপ নীরজাকে সমর্পণ করছেন। আমি তাঁকে যদিও বল্লেম, নীরজার আমি যোগ্যপাত্র নই, প্রমোদই তার যোগ্যপাত্র তিনি আমাকেই জামাতা করবেন স্থির করেছেন।”

 শুনিয়া প্রমোদের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল, কথাটি তীক্ষ্ণ শেলস্বরূপ তাঁহাকে বিদ্ধ করিল। কিন্তু তিনি আপনাকে সামলাইয়া লইতে চেষ্টা করিলেন, ভাবিলেন যামিনী নীরজার স্বামী হইবে ইহাতো সৌভাগ্যের কথা, প্রমোদ যদি নীরজাকে যথার্থ ভাল বাসেন, ইহাতে তাঁহার আনন্দ হওয়াই উচিত। এইরূপে মনকে যুক্তি দ্বারা বুঝাইতে চেষ্টা করিয়া মনে মনে স্থির করিলেন, যতই কষ্ট হউক, ভবিষ্যতে তিনি আপনার স্বার্থময় ইচ্ছা ত্যাগ করিয়া নীরজার সুখেই সুখী হইতে চেষ্টা করিবেন। কিন্তু বুদ্ধি এবং আকাঙ্ক্ষা দুইটি স্বতন্ত্র বস্তু, প্রায় স্থলেই ইহাদের বিরোধ ঘটে,—এবং উভয়ের তাড়নায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হইয়া উঠে। ঐ কথা শুনিবার পর হইতে প্রমোদ কেমন নিস্তব্ধ হইয়া পড়িলেন, কেমন অন্যমনষ্ক, কেমন নির্জীবভাবাপন্ন হইয়া পড়িলেন; সহস্র চেষ্টা করিয়াও আর আগের মত কথা কহিতে সক্ষম হইলেন না। এক দিকে মনকে বুঝাইবার ইচ্ছা, অপর দিকে হৃদয়ের সহস্র উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ বহিতে লাগিল। প্রমোদের চক্ষে গভীর চিন্তার ভাব, অথচ অধরে কষ্টনিঃসৃত শুষ্ক হাসির নিরুজ্জল আভাস। যদিও তিনি হৃদয়ের ভাব ঢাকিতে বলপূর্ব্বক হাসিতেছেন, কিন্তু, অনিচ্ছার সেই মৌখিক হাসিতে তাঁহার বিষাদভাব দ্বিগুণ প্রকাশিত হইতেছিল।