পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিয়ে, আমরা যোড়াসাঁকোর বাইরের বারান্দা থেকে খুব ঘটা করে, খাসগেলাসের বাতি জ্বালিয়ে, গড়ের বাদ্যি বাজিয়ে বর-আগমন দেখলুম। বর জুড়িঘোড়ার গাড়িতে বসা, মাথার উপর ছত্র ধরা—দেখতে খুব সুন্দর, সব ভাইদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে গৌরবর্ণ। গাড়ির থেকে নেমে ৬।১ নম্বরের অন্তঃপুরে সে যে প্রবেশ করল-সেই অবধি অন্তরাল হয়ে গেল আমাদের চোখের থেকে ও জীবনের থেকে। গগন-দাদাদের সঙ্গে যোড়াসাঁকোর এ বাড়ির সামাজিকভাবে মেলামেশা নেই, আদান-প্রদান নেই, তখন পর্যন্ত—প্রাইভেটভাবে ছেলেদের যাতায়াত থাকলেও। পাথুরেঘাটার, কয়লাহাটার ও মদনবাবুদের বাড়ির পুরুষ ও মেয়েরাই তাঁদের বেশি আপন—মহর্ষির বাড়ির সবাই রক্তেতে নিকটতর হলেও ব্যবহারে পর। অথচ একদিন এল যেদিন এই রজনী ও সুনয়নীর মেয়ের সঙ্গেই দ্বিপদাদার ছেলে দিনুর বিয়ে হল। দিনুর সেই প্রথম পত্নী। তার অকালমৃত্যুর পর দিনুর দ্বিতীয়বার বিবাহ হল মদনবাবুদের বাড়িতে, ঠাকুর গোষ্ঠীর এমন একটি ঘরে যাদের সঙ্গে সামাজিকতা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কাল যেমন নিকটকে দূর করে, তেমনি আবার দুরে সরাকে কাছে টেনে আনে। গগনদাদাদের বড় বোন বিনয়নীরই মেয়ে প্রতিমা-রথীর স্ত্রী। সে কিন্তু অনেক পরের কথা। সুনয়নীর সঙ্গে বিয়ের পর থেকে রজনী ঘরজামাই হয়ে সেই যে ৬।১নং-এ বাস করতে লাগল—আর আমাদের সঙ্গে তিলমাত্র সম্পর্ক রইল না। ওবাড়ির মেয়েদেরই মত সেও অসূর্যম্পশ্য হল এ বাড়ির সম্পর্কিত সকলের। তখনো তার ছোট ভাই সজনী ও সেজদাদা যোগিনীর কিন্তু মাহিনী রমণীবাবুদের সঙ্গে সঙ্গে কাশিয়াবাগানে সমান গতিবিধি রইল। যোগিনীর শুধু, গতি নয়, একেবারে স্থিতি বল্লেও চলে। মোহিনীবাবু, সুবিজ্ঞ, সুপণ্ডিত; রমণীবাবু প্র্যাকটিক্যাল কমনসেন্সবান-তিনিও পড়াশুনায় অগ্রণী, তখনই বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপক। এণ্ট্রান্সের সময় ইংরেজী বইগুলিতে তিনি আমাকে খুব তৈরী করে দিয়েছিলেন। সজনী ছেলেমানুষ, পাগলাটে, পরে বোধহয় একেবারেই পাগল হয়ে গিয়েছিল। আর যোগিনী—কি বলব? কখনো একান্ত মৌন-তখন দাদারা ঠাট্টা করতেন—“পিঞ্জরে বসিয়া শুক মুদিয়া নয়ন, কি ভাবিছ মনে?” চটত না কিন্তু, একেবারে নির্বিকার। কখনো খুব বাক্যবাগীশ। দশ-পঁচিশ প্রভৃতি খেলায় যে দানটা চায়, ঠিক সেইমত কড়ি ফেলতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। তর্কে ও তাসে তাকে পরাস্ত করা প্রায় অসম্ভব।

৯৯