পাতা:জীবনের ঝরাপাতা.pdf/৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একবার নাকি তাই হয়েছিল, আমাদের সংবাদদাতা সুপ্রভাদিদির জ্ঞাপিত এই সংবাদ।

 ছুটির দিন ঊষাদিদির লুচি আলুভাজির সঙ্গে আমার লুচিগুড় মিশিয়ে পরস্পরের মুখে তুলে দিয়ে খেতে পরম তৃপ্তিলাভ হত দুজনের। সাত-আট বছরের বালিকাদের পরস্পরের প্রতি টানটা একটা বড় বিদ্ঘুটে ভাষায় একদিন ব্যক্ত হল। কথাটার ওজন না বুঝে ভাবে গদগদ হয়ে একদিন বল্লুম—তোমার মা-বাবা যখন থাকবেন না তোমাকে আর তোমাদের ঘরে গিয়ে শুতে হবে না, সারা দিনরাতই আমাদের কাছে থাকতে পারবে, কখ্‌খনও আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে না।

 কথাটা ঊষাদিদির বড়বোন সরোজদিদির কানে উঠল। উঠতেই চারিদিকে রটে গেল—“কি সর্বনেশে কথা! কি দুষ্টু মেয়ে! এমন কথা মুখে আনে।” যে কথাটা নিছক ভালবাসার একটা চরম ব্যঞ্জনারূপে মুখ দিয়ে ফুটেছিল, যার ভিতর প্রেমিক হৃদয়ের ক্ষণমাত্র বিরহহীন মিলনের আকাঙ্ক্ষাটা শিশুর হৃদয় ভেদ করে ব্যক্ত হয়েছিল—তার মর্ম কেউ ধরলে না। চারদিক থেকে ধিক্কার আসতে লাগল। একটা ভয়ানক অকথনীয় কিছু বলেছি অনুমান করলাম। এতটুকু মেয়ের মুখে একথা বেরল কি করে? সে ভিতরে ভিতরে কত স্নেহক্ষুধায় ভরা ছিল, তারই বাইরে প্রকাশ এটা। যে মাকে আঁকড়াতে পারে না, মায়ের কোলে ঝাঁপাতে পারে না, সে কাউকে আঁকড়াতে চায়। এত বড় প্রকাণ্ড বাড়িতে যেখানে বড়দের সবই চলছে—আমোদপ্রমোদ ও স্নেহ-ভালবাসা অন্য ছেলেমেয়েদের জন্যে—সেখানে নতুন মামী ছোট বোন ঊর্মিলাকে যেমন ভালবাসতেন, তাকে যেমন বুকে করে নিয়েছিলেন, আমাকে যদি তেমনি কেউ স্নেহ দিয়ে ঘিরত, তাহলে ঊষাদিদিকে যে বড্ড ভালবাসি, সেইটে এই রকম ভাষায় ফুটে উঠত না। তাই অপরাধের গুরুত্বটা ঠিক কোন্‌খানটায় তা ধরতে পারলাম না। “বাবা-মা না থাকার” মানে যে ঘরে একেবারে মৃত্যুর করালমূর্তিকে ডেকে আনা—তা কল্পনায়ও আনতে পারলাম না। কেউ না থাকার মানে যে আপন জনের মৃত্যু-কালিমায় গৃহ আচ্ছন্ন হওয়া, সেটা যে কতদূর শোচনীয় ব্যাপার—যার দরুন বলে শত্রুরও মৃত্যু কামনা করতে নেই,—তা তখন আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধারণার অতীত।

 মৃত্যুছায়ার একটা আভাস এল আমার জীবনে আমাদের সব ছোটবোন উর্মিলার হঠাৎ মৃত্যুতে। ঊর্মিলা ছিল নতুন মামীর আদুরে। তিনিই তাকে দেখতেন শুনতেন খাওয়াতেন পরাতেন। তাঁর সঙ্গে সে

২১