পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মশা জিজ্ঞাসা করিলেন,— “কেন? কি হইয়াছে? তোমার স্ত্রী তোমার প্রতি কিরূপ অত্যাচার করেন?”

 খর্ব্বুর উত্তর করিলেন,— “প্রভু! আমাদের স্ত্রী-পুরুষে সর্ব্বদা বিবাদ হয়। দিনের মধ্যে দুইতিন বার মারামারি পর্যন্ত হইয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের কথা আর মহাশয়কে কি বলিব! আমি হইলাম, তিন হাত লম্বা, আমার স্ত্রী হইলেন, সাত হাত লম্বা। যখন আমাদের মারামারি হয়, তখন আমার স্ত্রী নাগরা জুতা লইয়া ঠনঠন করিয়া আমার মস্তকে প্রহার করেন। আমি ততদূর নাগাল পাই না; আমি যা মারি, তা কেবল তাঁর পিঠে পড়ে। স্ত্রীর প্রহারের চোটে অবিলম্বেই আমি কাতর হইয়া পড়ি, আমার প্রহারে স্ত্রীর কিন্তু কিছুই হয় না; সুতরাং স্ত্রী নিকটে আমি সর্ব্বদাই হারিয়া যাই। এক মার খাইয়া, তাতে মনঃক্লেশে শরীর আমার শীর্ণ হইয়া যাইতেছে, দেহে আমার রক্ত নাই। সেজন্য মহাশয় রাগ করিতে পারেন, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি কি করিব? আমার অপরাধ নাই।”

 মশা বলিলেন,— “বটে! আচ্ছা, তুমি এক কর্ম্ম কর। আজ হাতী ভায়ার পিঠে চড়িয়া তুমি স্ত্রীর সহিত মারামারি কর।”

 এই বলিয়া মশা খর্ব্বুরকে হাতীটি দিলেন। খর্ব্বুর হাতীর পিঠে চড়িয়া বাড়ীর ভিতর গিয়া স্ত্রীর সহিত বিবাদ করিতে লাগিলেন। কথায় কথায় ক্রমে মারামারি আরম্ভ হইল। খর্ব্বুর আজ হাতীর উপর বসিয়া মনের সুখে ঠনঠন করিয়া স্ত্রীর মাথায় নাগরা জুতা মারিতে লাগিলেন। আজ স্ত্রী যাহা মারেন, খর্ব্বুরের গায়ে কেবল সামান্যভাবে লাগে। যখন তুমুল যুদ্ধ বাঁধিয়া উঠিল, মশার তখন আর আনন্দের পরিসীমা রহিল না। মশার হাত নাই যে, হাততালি দিবেন, নখ নাই যে নখে-নখে ঘর্ষণ করবেন! তাই তিনি কখনও এক পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন, কখনও দুই পা তুলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন ও গুনগুন করিয়া “নারদ নারদ” বলিতে লাগিলেন। অবিলম্বেই আজ খর্ব্বুরের স্ত্রীকে পরাভব মানিতে হইল। খর্ব্বুরের মন আজ আনন্দে পরিপূর্ণ হইল। খর্ব্বুরের ধমনী ও শিরায় প্রবলবেগে আজ শোণিত সঞ্চালিত হইতে লাগিল। মশা, সেই রক্ত একটু চাকিয়া দেখিলেন, দেখিয়া বলিলেন,— “যাঃ! অতি সুমিষ্ট, অতি সুস্বাদু!”

 মশা মহাশয়কে খর্ব্বুর শত শত ধন্যবাদ দিলেন ও কি জন্য তাঁহাদের শুভাগমন হইয়াছে, সে কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। কঙ্কাবতী ও নাকেশ্বরীর বিবরণ মশা মহাশয় আদ্যোপান্ত তাহাকে শুনাইলেন। সমস্ত বিবরণ শুনিয়া খর্ব্বুর বলিলেন,— “আপনাদের কোনও চিন্তা নাই। নাকেশ্বরীর হাত হইতে আমি ইহার পতিকে উদ্ধার করিয়া দিব। ভূত, প্রেতিনী, ডাকিনী, সকলেই আমাকে ভয় করে। চলুন, আমাকে সেই নাকেশ্বরীর ঘরে লইয়া চলুন, দেখি সে কেমন নাকেশ্বৱী!”

 মশা বলিলেন,— “এবার চল! কিন্তু তোমাদের চলাচলি সব শেষ হইল। বড় সব জাহাজে চড়িয়া, কোথায় রেঙ্গুন, কোথায় বিলাত, এখানে ওখানে সেখানে যাইতে আরম্ভ করিয়াছে! বড় সব রেলগাড়ী করিয়া এ-দেশ ও-দেশ করিতেছ! রও, এবারকার শাস্ত্র একবার জারি হইতে দাও, তাহা হইলে টের পাবে।”

 খর্ব্বুর জিজ্ঞাসা করিলেন,— “এবার শাস্ত্রে আমাদের গমনাগমন একেবারেই নিষিদ্ধ হইল না কি? গাছগাছড়া আনিতে যাইতেও পাইব না?”

 মশা উত্তর করিলেন,— “না! এখানকার শাস্ত্রে লেখা আছে যে, ঘর হইতে তোমরা আর একেবারেই বাহির হইতে পরিবে না। সকলকে অন্ধকূপ খনন করিতে হইবে, চক্ষে ঠুলি দিয়া

১০৪
ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ