পাতা:ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ.djvu/১৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সপরিবারে কলিকাতা হইতে দেশে আসিলেন। রামহরির সহিত জনার্দ্দন চৌধুরী অনেকক্ষণ পরামর্শ করিলেন। তাহার পর রামহরি নিরঞ্জনকে ডাকিয়া আনিলেন। রামহরি, নিরঞ্জন, আমাদের কর্ত্তাটি ও খেতু সকলে মিলিয়া জনার্দ্দন চৌধুরীর বাটীতে যাইলেন। জনার্দ্দন চৌধুরী বলিলেন,— 'আমি পাগল হইয়াছিলাম যে, এই বৃ্দ্ধবয়সে 'আমি পুনরায় বিবাহ করিতে ইচ্ছা' করিয়াছিলাম। নিরঞ্জনকে আমি দেশত্যাগী করিয়াছি, খেতু বালক, তাহার প্রতি আমি ঘোরতর অত্যাচার করিয়াছি। সেই অবধি নানাদিকে আমাদের অনিষ্ট ঘটিতেছে। লোকের টাকা আত্মসাৎ করিয়া ষাঁড়েশ্বর কয়েদ হইয়াছে। গোবৰ্দ্ধন শিরোমণি পক্ষাঘাত রোগে মরণাপন্ন হইয়া আছেন। বৃদ্ধবয়সে আমাকে এই দারুণ শোক পাইতে হইল। এঁর কন্যাটিও রক্ষা পাওয়া ভার।' এই কথা বলিয়া তিনি নিরঞ্জনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার ভূমি ফিরিয়া দিলেন। নিরঞ্জন এখন আপনার বাটীতে বাস করিতেছেন। খেতুকে অনেক আশীর্ব্বাদ করিয়া জনার্দ্দন চৌধুরী সান্ত্বনা করিলেন। আমাদের কর্ত্তাটি আর সে মানুষ নাই। এক্ষণে তাঁহার মনে স্নেহ-মায়া, দয়া-ধর্ম্ম হইয়াছে। বিপদে পড়িলে লোকের এইরূপ সুমতি হয়। তোমার দাদাও এখন আর সেরূপ নাই। মাকে যেরূপ আস্থা-ভক্তি করিতে হয়, সুপুত্রের মত তোমার দাদাও এক্ষণে আমাকে আস্থা-ভক্তি করে। তোমার পীড়ার সময় তোমার দাদা অতিশয় কাতর হইয়াছিল। তুমি ভাল হইলে খেতুর সহিত তোমার বিবাহ হইবে। এবার আর একথার অন্যথা হইবে না। তোমার পীড়ার সময় খেতু, খেতুর মা, রামহরি, সীতা প্রভৃতি সকলেই প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছেন। এক্ষণে সকল কথা শুনিলে, এখন আর অধিক কথা কহিয়া কাজ নাই। এখনও তুমি অতিশয় দুর্ব্বল। পুনরায় অসুখ হইতে পারে।”

 কঙ্কাবতী অনেক দিন দুর্ব্বল রহিলেন। ভাল হইয়া সারিতে তাঁহার অনেক বিলম্ব হইল। সীতা তাঁহার নিকট আসিয়া সর্ব্বদা বসিতেন। স্বপ্নকথা তিনি সীতার নিকট সমুদয় গল্প করিলেন। সীতা মাকে বলিলেন, বৌদিদি খেতুকে বলিলেন, এইরূপে কঙ্কাবতীর আশ্চর্য্য স্বপ্নকথা পাড়ার স্ত্রী-পুরুষ সকলেই শুনিলেন। স্বপ্নকথা আদ্যোপান্ত শুনিয়া কঙ্কাবতীর উপর সীতার বড় অভিমান হইল।

 সীতা বলিলেন,—"সমুদয় নক্ষত্রগুলি তুমি নিজে পরিলে, আর আপনার পচাজলকে দিলে। আমার জন্য একটিও রাখিলে না। আমাকে তুমি ভালবাস না, তুমি তোমার পচাজলকে ভালবাস। আমি তোমার সহিত কথা কহিব না।”

 কঙ্কাবতী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিলেন। পূর্বের ন্যায় পুনরায় সবল হইলেন। পীড়া হইতে উঠিয়া তিনি খেতুর সম্মুখে একটু-আধটু বাহির হইতেন। একদিন খেতু কঙ্কাবতীদের বাড়ীতে গিয়াছিলেন। সেইখানে একটি মশা উড়িতেছিল। খেতু সেই মশাটিকে ধরিয়া কঙ্কাবতীকে জিজ্ঞাসা করিলেন,— “দেখ দেখি কঙ্কাবতী! এই মশাটি তো তোমার ‘পচাজল” নয়? আহা! রক্তবতী আজ অনেকদিন তাহার পচাজলকে দেখিতে পায় নাই। তাহার মন কেমন করিতেছে। তাই সে হয়তো তোমাকে খুজিতে আসিয়াছে।”

 লজ্জায় কঙ্কাবতী গিয়া ঘরে লুকাইলেন। সেই অবধি আর খেতুর সম্মুখে বাহির হইতেন না। নিরঞ্জন একদিন খেতুকে বলিলেন,— “খেতু! কঙ্কাবতীর অদ্ভুত স্বপ্নকথা আমি শুনিয়াছি। কি আশ্চর্য্য স্বপ্ন! কিন্তু স্বপ্ন বা বিকারের প্রলাপ বলিয়া তুমি উপহাস করিও না। স্বপ্ন,— কি নয়? তাহাই বুঝিতে পারি না। এই আমাদের জীবন, আমাদের আশা-ভরসা, সুখ-দুঃখ, সকলই স্বপ্লবৎ বলিয়া বোধ হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এই অপূর্ব্ব মায়া কিছুই বুঝিতে পারি না। সামান্য একটি পদার্থের কথাই আমরা ভালরূপ অবগত নাহি। এই দেখ, আমার হাতে এখন যে

কঙ্কাবতী
১২৯