৬
সেদিন রাত্রে গােপির পায়ের যন্ত্রণা খুব বাড়িয়া গেল। তাহাকে নূতন ঘরে আনা হইয়াছিল, সারারাত সে ছটফট করিয়া গােঙাইয়া কাটাইয়া দিল। মালা জাগিয়া বসিয়া রহিল তাহার শিয়রে। কুবেরও অনেক রাত অবধি জাগিয়া রহিল। তারপর সে ঘুমাইয়া পড়িল বটে কিন্তু ভালাে ঘুম হইল না। শেষরাত্রে উঠিয়া বসিয়া সে ডাকিল, গােপির মা?
জবাব দিল কপিলা।—গােপির মা ঘুমায়।
কুবের উঠিয়া আসিয়া বলিল, যা তুই ঘুমা গা কপিলা, আমি বইয়া থাকি।
কপিলা চাপা গলায় বলিল, আরে পুরুষ! রাত ভইরা ঘুমাইয়া বিয়ানে কয়, যা তুই ঘুমা গা কপিলা। কাউয়ায় ডাক পাড়ে শুনছ মাঝি?
তাইতাে বটে! ফরসা হইয়া আসিয়াছে যে!
ঝাঁপ খুলিয়া কুবের বাহিরে গেল। গণেশের বাড়ি গিয়া ডাকাডাকি করিয়া তুলিল গণেশকে। যুগল কাল বােনের বাড়ি নেমন্তন্ন খাইতে আসিয়া রাত্রে এখানেই ঘুমাইয়াছিল, সে-ও উঠিয়া আসিল। কুবের বলিল, গণেশ, মাইয়ারে ত হাসপাতালে নেওন লাগে, বড়াে কাতর মাইয়া, রাইত্ ভইরা চেঁচাইয়া মরছে।
গণেশ বলিল, হ?—ব কুবির, তামুক খা। হাসপাতালে নেওন ত সহজ কথা না! কিবা নিবি ভাবছস নি?
নাও নিয়া যামু, আবার কিবা?
সমস্যার সমাধানে গণেশ খুশি হইয়া বলিল, তবে চিন্তা নাই, যুগইলার নাওখান মিলব আইজ, ও নিয়া আইছে যুগইলা।—নাওখান দিবি না যুগইলা তর?
যুগল সাগ্রহে নৌকা দিতে সম্মত হইল। বলিল, সেও সঙ্গে যাইবে। খুব বুঝি ফুলিয়াছে গােপির পা-টা? কোথায় চোট লাগিয়াছে? আগে কেন মেয়েকে হাসপাতালে দেয় নাই কুবের—আগেই লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। যাই হােক, আজ যদি হাসপাতালে লইতেই হয়, দেরি করিয়া লাভ কী? বেলা হইয়া গেলে হাসপাতালে ডাক্তারকে পাওয়া যাইবে না।
একটা চওড়া কাঠের তক্তায় শােয়াইয়া ধরাধরি করিয়া গােপিকে নদীতীরে লইয়া যাওয়া হইল। কাঁথা বালিশ হাতে করিয়া কপিলা গেল সঙ্গে। ইতিমধ্যে জেলেপাড়ায় খবর রটিয়া গিয়াছিল। গ্রামের একটি মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়া প্রতিমা বিসর্জনের চেয়ে কম গুরুতর ব্যাপার নয় জেলেপাড়াবাসীদের কাছে—এই ভােরে নদীতীরে একটি ছােটোখাটো ভিড় জমিয়া গিয়াছিল। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে কুবেত একেবারে হয়রান।
কপিলা আগে নৌকায় উঠিয়া কাঁথাপত্র বিছাইয়া দিল, তারপর গােপিকে তুলিয়া শােয়ানাে হইল। যন্ত্রণায় ও ভয়ে গােপির মুখখানা ফ্যাকাশে হইয়া গিয়াছে। হাসপাতাল? না জানি কী ভয়ংকর সেই স্থান! কে জানে সেখানে কী হইবে তাহার! কপিলার একটা হাত গােপি সবলে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিল।