পাতা:পদ্মানদীর মাঝি - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পদ্মানদীর মাঝি
৮৩

 হােসেন বলিল, হারামির পােলারে কাইটা দরিয়ায় দিলা না ক্যান?

 বিপিন স্বীকার করিল অতটা তাহারা করিতে পারে নাই, তবে মারধাের করা হইয়াছে যথেষ্ট। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সকলকে হােসেন ডাকিয়া আনিতে বলিল, এনায়েতও যেন আসে। অল্পক্ষণের মধ্যেই সকলে আসিয়া জুটিল, মেয়েরাও কেহ কেহ আসিয়া তফাতে দাঁড়াইয়া রহিল কৌতুহলের সঙ্গে। বিচার হইবে এনায়েতের। কে জানে তাহাকে শূলেই দিবে না সাগরে ডুবাইয়া মারিবে হােসেন।

 এনায়েতের বয়স বেশি নয়, বলিষ্ঠ যুবক সে, ময়নাদ্বীপে এমন আর একটা মানুষও নাই। তেজের সঙ্গে সে আসিয়া হােসেনের সামনে বসিল, নির্ভয় নিশ্চিন্ত। হােসেন একে ওকে দুটো-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিল, রুষ্ট চোখে এনায়েতের দিকে চাহিতে লাগিল, বারবার বলিতে লাগিল, কী আপশােশ! কী আপােেশ!

 তারপর সে কৈফিয়ত তলব করিল এনায়েতের।

 এনায়েত বলিল, জবরদস্তি করি নাই মিয়া।

 হােসেন বলিল, না করলা জবরদস্তি, বসিরের ঘরের মদ্যি যাবা ক্যান তুমি? কবিলারে নজর দিবা ক্যান?

 আমারে দেইখা একরােজ স্যায় হাসিল।

 আরে বলদা তুমি। বাই বইলা হাসিল, দ্যাশগাঁও ছাইড়া দ্বীপের মদ্যি আইসা রইছ, বাই বইন না মাইয়া মরদ এ্যানে? ভালা কাম কর নাই মিয়া। তিন রােজ বাইন্ধা থুমু তােমারে, খানাপিনা মিলব না।

 তখন হােসেন মিয়ার হুকুমে সকলে মিলিয়া তাহাকে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে বাঁধিয়া দিল। আলগা করিয়াই বাঁধিল, হােসেন মিয়ার হুকুমের চেয়ে দড়ির বাঁধন তাে এ দ্বীপে জোরালাে নয়, বাঁধন খুলিয়া পালানাের সাহস এনায়েতের হইবে না। কোথায় পালাইবে?

 হােসেনের ঘরের কাছেই একখানা ঘরে কুবের ও তাহার সঙ্গীদের থাকিতে দেওয়া হইয়াছিল। সেদিন অনেক রাত্রে বাহিরে গিয়া জ্যোৎস্নালােকে কুবের দেখিতে পাইল হােসেনের ঘরের দাওয়ায় বন্দী এনায়েত থালায় ভাত খাইতেছে, কাছে বসিয়া আছে একটি রমণী। চুপিচুপি কুবের ঘুরিয়া হােসেনের ঘরের পিছনের দিকে গেল, জানালা দিয়া আস্তে আস্তে তাহাকে ডাকিয়া তুলিল।

 খবর শুনিয়া হােসেন হাই তুলিয়া বলিল, হ? ঘুমাও গা-কুবির। আর শােনো বাই, কী দেখলা কী শুনলা আঁধার রাইতে মনে মনে থুইও, কইয়া কাম নাই।

 বলিয়া হােসেন পাশ ফিরিয়া শুইল।

 এত বড়াে একটা ব্যাপারকে অবহেলা কৱিয়ে হােসেনের পাশ ফিরিয়া শােয়া অবাক করিয়া দিল বটে কুবেরকে আজ, ব্যাপার সে বুঝিতে পারিল দ্বীপ ছাড়িয়া ফিরিবার দিন। বুড়া বসির নৌকায় আসিয়া উঠিল, তাহার ছেলেমানুষ বউ রহিয়া গেল দ্বীপে। বসির এ দ্বীপের আদি বাসিন্দা, প্রায় পাঁচ বছর এখানে সে সস্ত্রীক বাস করিতেছে। ছেলেমেয়ে হয়