কী কও কুবির বাই, তাই না? হােসেন মৃদু মৃদু হাসে।
হ, বলিয়া কুবের সায় দেয়।
সকলের চেয়ে বিশ্বাসী, সকলের চেয়ে নিরাপদ এই সরল পদ্মানদীর মাঝিটাকে হােসেন মিয়া যেন ভালােবাসে। কত টাকা হােসেন মিয়ার, দূরে দূরে ছড়ানাে কত বড়াে তাহার ব্যাবসা, এগারাে মাইল লম্বা একটা দ্বীপের সে মালিক, কুবের তাে তাহার চাকর, তবু কুবেরের ঘরে ছেঁড়া চাটাইয়ে হােসেন আরাম করিয়া বসে, বন্ধুর মতাে গল্প করে কুবেরের সঙ্গে। চেনাই যেন যায় না এখন হােসেনকে। হােসেনের নৌকায় কাজ নেওয়ার আগে কুবের তাে তাকে শুধু সংগতিপন্ন বলিয়া জানিত, অসংখ্য উৎস হইতে হােসেনের যে কত টাকা আসে এখন ভাবিতে গেলে কুবেরের মাথা ঘােরে। সে আর গণেশ শুধু জানিয়াছে, কেতুপুরের আর কেহ হােসেন মিয়ার রহস্য জানে না।
টাকাওয়ালা মানুষের সঙ্গে মেশে না হােসেন, তাদের সঙ্গে সে শুধু ব্যাবসা করে, মাল দিয়া নেয় টাকা, টাকা দিয়া নেয় মাল। মাঝিরা তাহার বন্ধু। অবসর সময়টা স পদ্মার দীন দরিদ্র মাঝিদের সঙ্গে গল্প করিয়া কাটাইয়া দেয়, টাকায় ফাঁপানাে ব্যাগ পকেটে নিয়া বর্ষার রাত্রে জীর্ণ চালার তলে চাটাইয়ে শুইয়া নির্বিবাদে ঘুমাইয়া পড়ে।
সেদিন রাত্রে মালা ফিরিল না।
পরদিন বেলা বারােটার সময় হাতের ভরে দুলিয়া দুলিয়া সে গৃহে প্রবেশ করিল, নদীর ঘাট হইতে এতটা পথ এমনিভাবে আসিতে কাপড়খানা তাহার কাদামাখা হইয়া গিয়াছে। কুবের খাইতে বসিয়াছিল, একবার চাহিয়া দেখিয়া আবার খাওয়ায় মন দিল। ঘরে গিয়া কাপড় বদলাইয়া মালা দাওয়ায় আসিয়া বসিল। কুবের চোখ তুলিয়া তাকায় না। চড়া গলায় পিসিকে আর দুটি ভাত আনিতে বলে।
মালা বলে, আগাে শুনছ?
কুবের শুনিতে পায় না, সে বধির হইয়া গিয়াছে।
মালা বলে, তুমি তাে নিলা না, রাসুর লগে তাই হাসপাতাল গেছিলাম। গােসা নি করছ?
জবাবের জন্য মালা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর সজল কণ্ঠে বলে, ডাক্তর কয়, পাও সারনের না আমার।
আরও কত কথা মালা বলে, কুবের সাড়াশব্দ দেয় না। খাইয়া উঠিয়া নীরবে তামাক টানিতে থাকে। গোঁয়ার কি সহজ কুবের!
মালা শেষে রাগিয়া বলে, ক্যান মাঝি ক্যান, এত গোসা ক্যান? কবে কই নিছিলা আমারে, চির কাল ঘরের মধ্যি থাইকা আইলাম, এউক্কা দিনের লাইগা বেড়াইবার যাই যদি, গােসা করবা ক্যান?
যা, বেড়া গিয়া মাইজা কত্তার লগে—হারামজাদি, বদ!
কী কইলা মাঝি, কী কইলা?