পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পটুয়৷ সঙ্গীত * শ্ৰীখগেন্দ্রনাথ মিত্র আমাদের সংস্কৃতির ধারা যে সময়ে বালুকারাশির মধ্যে বিলীন হইতে চলিয়াছে, সেই সময়ে জন কয়েক মনীষীর অক্লান্ত চেষ্টায় তাহার লুপ্ত রেখাটি ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুদ্র সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত হইতেছে । কোনও জাতির ইতিহাস সম্পূর্ণ ভাবে আবিষ্কৃত হইতে পারে না, যতক্ষণ তাহার সংস্কৃতি এবং পরিণতির ধারাটির উদ্ধারসাধন না হয় । এই সম্প-টি সমস্ত জাতির সম্বন্ধেই প্রযোজ্য হষ্টলেও আমাদের সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। কারণ আমাদের ইতিহাস নানা কারণে অপরিজ্ঞাত বা অল্পপরিজ্ঞাত । এই জন্য আমাদের দেশের প্রাচীন সংস্কৃতির সমস্ত নিদর্শন সংগ্ৰহ করা প্রয়োজন । আমাদের বগুমান নাগরিক জীবন হইতে তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না । বহুপ্রাচীন কাল হইতে বাংলার পল্লীর মধ্যেঙ্গ বাঙালীর প্রাণের স্পন্দন অল্পবিস্তর পাওয়া যায়। সেই জন্য আমাদের পল্লীসঙ্গীতে, ছড়া ও রূপকথায়, ব্রত ও নৃত্যে, যাত্রা ও কবির গানে বাঙালীর সংস্কৃতির একটি অখও অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ পাওয়া যায় । পটুয়া সঙ্গীত সেই হিসাবে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের একটি মূল্যবান উপাদান যোগাইয়াছে। বীরভূমের পল্লীতে পটুয়াগণ বা চিত্রকরেরা এই সঙ্গীত গান করিয়া কিছু দিন পূৰ্ব্বেও জাবিক অর্জন করিত। অবস্থার ঘাত-প্রতিঘাতে বাংলার এই নিজস্ব সংস্কৃতি লোপ পাইতে বসিয়াছে। শ্রীযুক্ত গুরুসদয় দত্ত মহাশয় এই গুলির সংরক্ষণে সহায়তা করিয়া যাঙালী জাতির কৃতজ্ঞতাভজন হইয়াছেন । বীরভূমেয় এবং বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের নুত্যকলা সাধারণ্যে প্রচারিত কবিয়া তিনি যশস্বী হইয়াছেন । দেশের পুরাতন সংস্কৃতি সংরক্ষণের ইতিহাস যখন লিখিত হইবে, তখন শ্রযুক্ত গুরুসদয় দত্বের নাম সন্ত্রমের সহিত উল্লিখিত হইবে, এ-বিষয়ে সন্দেহ নাই । পশ্চিম-রাঢ়ের জনসাধারণের মধ্যে যে সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল, তাহারই অপূৰ্ব্ব নিদর্শন এই পটুয়া সঙ্গীত। ইহার বৈশিষ্ট্য এই যে, সঙ্গীত ও চিত্রকলার এরূপ অপূৰ্ব্ব সমাবেশ আমরা

  • শ্ৰীযুক্ত গুরুসদয় দত্ত আই সি এস সংকলিত ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কত্ত্বক প্রকাশিত। পত্রাঙ্ক ১৭/১ + ১১৬ ৷

অন্যত্র পাই না । আমাদের দেশে ব্যবসায়ের বনিয়াদে জাতিভেদের দৃষ্টাস্ত বিরল নহে। তত্ত্ববায়, স্বর্ণকার, কুম্ভকার প্রভৃতি পুরুষপরম্পরাক্রমে জাতীয় বৃত্তি অবলম্বন করিয়া বহিয়াছে। ইহাতে এক দিকে যেমন ব্যবসায়ের অক্ষুণ্ণতা বজায় রাখিয়াছে, তেমনি আবার উন্নতির পথও অনেক সময়ে রুদ্ধ কবিয়াছে। জাতিগত ব্যবসায়ে অনেক সময় সংরক্ষণের দিকে বড় বেশী দৃষ্টি দেওয়া হয়। তাহাতে নবনবোন্মেষশালিনী প্রতিভার অবকাশ বড় বেশী থাকে না । এ-ক্ষেত্রেও সম্ভবতঃ তাঙ্গাই হইয়াছে। পটুয়াদের চিত্রে ধারাবাহিকতা এবং গতানুগতিক ভাব যতটা দেখা যায়, ততটা উৎকর্ষপারিপাট্য দেখা যায় না। কিন্তু অপর দিকে ইহার মূল্য আছে : পুরাতন সরস মৌলিকতা এবং অকৃত্রিমতা ইহাদের মধ্যে পাওয়া যায় । অন্য কোথায়ও তাহা সুলভ নহে । আমার বক্তব্যের উদেশ্ব ইহা নয় যে, পটুয়াদের চিত্রসম্পদের কোনও মূল্য নাই। চিত্র হিসাবেও এই পটুয়াদের পটে এমন একটি সজীব, সতেজ, মৌলিক সৌন্দৰ্য্য ও ভাবব্যঞ্জনার পরিচয় পাওয়া যায় যাহা কলানৈপুণ্যের সুন্দর নিদর্শনরূপে গণ্য হষ্টতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় এই চিত্রকলা পল্লীজীবনের প্রতিচ্ছবিরূপেই অধিকতর মূল্যবান বলিয়া গণ্য হইতে পারে । পটুয়া সঙ্গীতের আর একটি অভিনবত্ব এই যে, এই চিত্রকরের সংস্কৃতি হিসাবে হিন্দু এবং ধৰ্ম্মে মুসলমান । ইহাদের নাম, আচার, ব্যবহার অনেকট হিন্দুদের মত । তাহা হইলেও ইহারা মুসলমান সমাজে স্থান লাভ করিয়াছে। যে-যুগে এইরূপ সমন্বয় সম্ভব হষ্টয়াছিল, সে-যুগ যে দ্রুত চলিয়া যাইতেছে ইছাই আক্ষেপের বিষয় । আমার বাল্যকালে মনে পড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইরূপ এক পোটোর নিকটে বসিয়া সময় কাটাইয়া দিয়াছি। তার নাম ছিল উমেশ । বাড়ী তার রাঢ়ে এবং জাতিতে সে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিত। আমাদের ঘরেই সে খাইত। তাহাকে ভাল চিত্রকর বলিয়া সকলেই খাতির কবিত। সে পূজার পূৰ্ব্বে