পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

889 প্রবাঙ্গী Sego সেটুকুকে শুষ্ক শিষ্টাচার বলিয়াই গণ্য করিতেন। দানের প্রতিদানে তাহার দিকের প্রতিদানের ওজনটাই ভারী করিবার ব্যগ্রতায় তিনি চলিয়াছিলেন। আজ যেন তিনি সহসা অমুভব করিলেন যে, এই চলার বেগটা তাহার স্বেচ্ছা-আরোপিত বেগ নয়—নিজের ইচ্ছায় নিজের বেগেই তিনি চলিতেছেন না ; অপরের চালনায় তিনি চালিত হইয়া চলিয়া চলিয়াছেন। আপনার সমস্ত চৈতন্যকে সতর্ক করিয়া আপনার চারি দিকে চাহিয়া দেখিলেন—আর চাহিয়া দেখিলেন সম্মুখের দিকে। অদৃষ্টবাদী হিন্দুর মন তাহার-ভিনি চারি দিকে কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না—কিন্তু কিছু যেন অনুভব করিলেন ; এবং সম্মুখের সমস্ত পথটা দেখিলেন এক রহস্যময় অন্ধকারের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য। তিনি পিছন ফিরিয়া পশ্চাতের পথের প্রকৃতি দেখিয়া সম্মুখের ঐ অন্ধকারাবৃত পথের প্রকৃতি অনুমান করিতে গিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। চক্রবর্তী-বাড়ীর জীবন-পথ যেখানেই রায়-বাড়ীর জীবনপথের সহিত মিলিত হইতে আসিয়াছে সেইখানেই একটা করিয়া ভাঙনের অন্ধকারময় খাত অতল অন্ধকূপের মত জাগিয়া রহিয়াছে ! কিন্তু উপায় কোথায় ? দিক পরিবর্তন করিয়া চলিবার কথা মনে হইয়াছে—কিন্তু সেও যে পরম লজার কথা । মনের ওজনে দান-প্রতিদানের পাল্লার দিকে চাহিয়া তিনি যে স্পষ্ট দেখিতেছেন-চক্ৰবৰ্ত্তী-বাড়ীর দানের পাল্লা এখনও মাটির উপর অনড় হইয়া বসিয়া রহিয়াছে—সস্তান সম্পদ সব যে চক্রবত্তী-বাড়ী পাল্লাটার উপর চাপাইয়াছে ! স্বনীতি অহীন্দ্র গভীর বিশ্বাসের সহিত সকরুণ দৃষ্টিতে র্তাহার দিকে চাহিয়া আছে তাহাদের পাওনা পাইবার প্রত্যাশায় ! জপ করিয়া শোধন-করা স্বরাপূর্ণ পানপাত্ৰ তুলিয়া লইয়া পান করিয়া রায় গভীর স্বরে আবার ডাকিলেন— কালী! কালী ! মা! তার পর আবার তিনি জপে বসিলেন। কিন্তু কাছারি-বাড়ী হইতে অচিস্ত্যবাবুর চিলের মত তীক্ষ কণ্ঠস্বর আসিতেছিল, লোকটা কাহারও সহিত চীৎকার করিয়া ঝগড়া বা তর্ক করিতেছে । তাহার ভ্র কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, পরক্ষণেই আপনাকে সংযত করিয়া প্রগাঢ়তর নিষ্ঠার সহিত সকল ইঞ্জিয়কে রুদ্ধ করিয়া ইষ্টদেবীকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন । অচিন্ত্যবাৰু ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন অমল ও অহীন্দ্রের উপর। সন্ধ্যার পর দুই জনে বেড়াইয়া আসিয়া চা পান করিতে করিতে পলিটিকৃসের আলোচনা করিতেছিল। অচিন্ত্যবাবু নায়েবের কাছে বসিয়া অনর্গল বকিতেছিলেন, সহসা চায়ের পেয়াল পিরিচের ঠুং ঠাং শব্দ শুনিবাবাত্র তিনি সে-ঘর হইতে উঠিয়া অমলদের আসরে আসিয়া জাকিয়া বসিলেন । অমল তীব্রভাবে ইংরেজ-রাজত্বের শোষণনীতির সমালোচনা করিতেছিল । অহীন্দ্র বলিল—পরাধীন জাতির এই অদৃষ্ট অমল, পরাধীনতা থেকে মুক্ত না হলে শোষণ থেকে অব্যাহভির উপায় নেই । পুতুলনাচের পুতুলের মত অচিস্তাবাবুর মুখ চায়ের কাপ হইতে অঙ্গীন্দ্রের দিকে ফিরিয়া গেল—সবিস্ময়ে অষ্ট্ৰীক্সের মুখের দিকে চাহিয়া তিনি বলিলেন—কি ? ইংরেজ-রাজত্ব তুমি উণ্টে দিতে চাও ? ঈষৎ হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল-চাইলেও সে ক্ষমতা আমার নেই, তবে অস্তরে অস্তরে সকলেই স্বাধীনতা চায় এটা সাৰ্ব্বজনীন সত্য। তক্তাপোষের উপর একটা চাপড় মারিয়া অচিস্তাবাৰু বলিলেন—নো নো, নো ! বলিতে বলিতে উত্তেজনার চাঞ্চল্যে থানিকট গরম চা তাহার কাপড়ে পড়িয়া গেল, ফলে তাহার বক্তব্য আর শেষ হইল না—চায়ের কাপ সামলাইতেই তিনি ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন । অমল বলিল—আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন ? অচিন্তবাবু বলিলেন—উত্তেজিত হব না ? সায়েবদের তাড়িয়ে কি রাজত্ব করবে তোমরা বাপু ? বলে, হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে চায় ! এমন বিচার করবার তোমাদের ক্ষমতা আছে ? তোমরা আজ চাকর রাখবে কাল তাড়াবে কুকুরের মত। কই গবর্ণমেণ্টের একটা পিওনের চাকরি সহজে যাক তো দেখি! তার পর বুড়ো হ’ল তো, পেন্সান ! এ বিবেচনা তোমাদের আছে ? অমল অহীন্দ্র উভয়েই এবার হাসিয়া ফেলিল ।