পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩য় সংখ্যা ] কল-কোলাহলও ক্ষণিকের জন্য শাস্ত হইয়া পড়িত, তখন গ্রীষ্মাধিক্যে মেঝের উপর মাদুর বিছাইয়া হরিহর ঘুমাইবার চেষ্টা করিত। কিন্তু নি:শব্দ মধ্যাহ্নের সুধোগ পাইয়া লালবাড়ীর বন্দী প্রাণ যেন ক্ষীণকণ্ঠে তাহার চোখের ঘুম তাড়াইয়া কি জানাইতে চাঙ্গিত । কে যেন অন্ধকার বন্ধ ঘরের এপ্রাপ্ত হইতে ও প্রান্ত পর্য্যন্ত চঞ্চলচরণে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, রুদ্ধ জানালার কবাটে কবাটে কিসের যেন টানাটানি ; বন্দিনী কি কবাট ভাঙিয়। এই পথে পলাইয়া যাইতে চায় ? দীর্ঘ বন্দীদশায় তাহার শ্বাস কি রুদ্ধ হইয়া আসিতেছে ? মেঝেতে কাণ আরও চাপিয়া ধরিয়া সে শুনিত কে ধেন ধুক ভাঙ্গ: কান্ন। টিপিয়া রাথিতে রাখিতে ফু পাইধু উঠিতেছে । ছুটিয়া বাহিরে আসিয়। সে দেখিত বহুকালের বন্ধ ক খড়গড়ির গায়ে মাকড়সার জালে ও ধূলার পরতে পরতে দীর্ঘ বিগত দিনমালাব স্বত্র বাড়িয়া চলিয়াছে মাত্র ; সেখানে চাঞ্চল্যের কোনো চিহ্ন নাই । জ্যোংস্নারাত্রে পোলা ছাদে শুইয়া নারিকেল-কুঞ্জের মাথায় চাদের আলোর ঝর্ণ ঝরিতে দেখিতে দেখিতে কতদিন হরিহরের মনে হুইয়াছে এই জ্যোৎস্নার স্বরের মত গভীর করি প্রেম-বিহবল কণ্ঠস্বর যেন পথপারের রুদ্ধ গৃহতল ভরিয়া তুলিতেছে। কোন সে প্রেমিক বাহিরের জ্যোৎস্নার রূপ উপেক্ষা করিয়া অন্ধকারের গোপন কোণে তাহার বন্দিনী প্রেয়সীর সন্ধানে লুকাইয়া আসিয়াছে কে জানে ? মনে হইত অন্ধকারের এই আনন্দ-উৎস যেন জ্যোংস্কার জোয়ারকেও ছাপাইয়া উঠিতেছে। পুপসৌরঙে নিশীথবায়ু ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিত, আকাশভর আলোর তলায় প্রকাণ্ড বাড়ীর জমাট অন্ধকারও যেন প্রাণরসে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিত। হয়ত বা এ কোন পলাতক প্রণয়ীযুগলের গুপ্ত বাসস্থান যাহারা মানুষের সকল সম্পর্ক সভয়ে এড়াইয়া চলে । এমুনি করিয়া কতদিন কাটিয়া গেল। ঋতুর পর ঋতু চঞ্চল গতিতে চলিয়া গেল ; কিন্তু বন্দিনীর মুক্তির চেষ্টা অrর করা হইয়া উঠিল না, গোপন-চারিণীর অন্তরের রহস্ত চিরআবুতষ্ট রহিয়া গেল। দুটি চারিটি, করিয়া দিনের সঙ্গে পুরানো দিনের চিন্তার ধারা যখন রুদ্ধগৃহ ●õዓ ক্রমে আগাগোড়া বদল হইয়া আসিতেছে, এমন সময় এক শুক্ল দ্বাদশীর রাত্রে খুটু করিয়া সাম্নের বাড়ীর দরজা খুলিয়া অবগুষ্ঠিতা দাসী আসিয়া হরিহরের দরজায় দাড়াইল। দাসী শুধু বলিল, “ডাক্তার বাবু একবার আমুন।” ডাক্তার কোনো প্রশ্ন না করিয়াই উঠিয়া পড়িল। ধীরে সিড়ি বাহিয়া নামিয়া সামনের দরজায় আসিয়া দাড়াইল । যে দরজায় কোনো দিন কাহাকেও পা দিতে দেখে নাই, তাহার চৌকাঠ ডিঙাইতে প। উঠিতেছিল না। দাসী বলিল, “ভিতরে চলুন।" দরজার ভিতর শ্বেতপাথরের মাজা-ঘসা মেঝে ঝকুঝকু করিতেছিল । ভিতরেব বারান্দায় সারি-সারি চীন। মাটির টবে ফুলের গাছ । পাশে চীনা মাটির বড় চৌবাচ্চায় কাচের মত স্বচ্ছ নিৰ্ম্মল জল কালে কাঠের খোলা দরজার ভিতর দিয়া দেপ। যাইতেছে । ছোট জলচৌকিতে রূপার ঘটি তেলের বাটি সাবানদানি সাজানে। কোনে। কিছুর গায়ে একটু ময়লার দাগ নাই । উপরে উঠিবার সিড়ির মুখোমুপি আবলুস্কাঠে বাধানে মস্ত বড় আয়না। হঠাং নিজের ছায়া দেখিয় মনে হয় খোলা দরজা দিয়া কে যেন উন্ট দিক্ দিয়া আসিতেছে । মাথার উপর রূপার ঝাড় দুলিতেছে, কিন্তু তা হাতে ধাতি নাই । দোতালার সামনের ঘরে লাল রেশমের পর্দা ঝুলিতেছে ; পর্দা তুলিয়। দাসী ভিতরে পথ দেখাইয়া লইয়৷ চলিল ; হাওয়ায় ওড়া পরদা ও অকস্মাংখোল দরজার ফাকে যে ঘরখানির একটু চিহ্ন এত দীর্ঘ দিনে দুই একবার মাত্র চোখে পড়িয়াছে, দেখিয়াই ডাক্তার তাঙ্গা চিনিল । সেই মেহগনীর জোড়া পালঙ্কের উপর শুভ্র চাদরে ঢাকা মখমলের গদি, সেই দেয়ালজোড় আয়নার দুই পাশে রূপার বাতি । পাশে ছোট তিন পায়ার উপর রূপার থালায় ফুলের মালা সাজানো, আলনায় জরি ও রেশমের ছড়াছড়ি, রঙে রঙে ঘর উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে, পায়ের কাছে রাঙা চটি ও জরির জুতা ; চৌকা একটা টেবিলের উপর সোণার চিরুণী কাটা, রেশমী ফিতা, গন্ধ তেল, প্রসাধনের আরো কত কি সরঞ্জাম । কোণে পিড়ির উপব কালো পাথরের জলের কুঁজা। রোগীর ঘরের এ কেমন সজ্জা ! কাহার'বাসর-গৃহে সে ভুল-করিয়া আসিয়া