شورایاری পড়িয়াছে ভাবিয়া ডাক্তার বিত্রত হইয়া পড়িতেছিল। কিন্তু ঘরে ত মানুষ নাই ! এই বেল পলাইতে পারিলেই ভাল ; নহিলে না জানি এখনি পরদা ঠেলিয়া কোন ইন্দ্রাশীর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আসিয়া তাহার উপর পড়িবে! স্বন্দরীর দেহ-যষ্টি যেন কোন তিরস্করিণী বিদ্যার জোরে দৃষ্টির বাহিরে রহিয়াছে মাত্র কিন্তু সমস্ত কক্ষতল তাহারি সত্তায় পরিপূর্ণ। আর-একটু আগাইয়া ঘরের ভিতরেরই আর-একটা পরদা তুলিয়া দাসী অন্ত ঘরে চলিল। শূন্যপ্রায় ঘরের কোণে ছোট একটি থাটে কে যেন শুইয়া আছে ; ঘরে আলো নাই, ভাল করিয়া দেখা যায় না । দাসী আলো জালিতেই রোগীর দিকে দৃষ্টি পড়িল । জীর্ণ শীর্ণ কঙ্কালসার দেহখানি বিছানার সঙ্গে মিলাইয়া গিয়াছে। সে চোখ মেলিয়া আলোর দিকে সভয়ে চাহিয়া লল, “আলো, আলো কেন ?” ভয়ে তাহার বিবর্ণ পাংশুমুখ শুকাইয়া উঠিল। দাসী ডাক্তারকে দেখাইয়৷ দিল। রোগী এইবার ফিরিয়া বলিল, “ডাক্তারবাবু, আমার কি হয়েছে বলতে পারেন।” হরিহর বলিল, “তাই দেখতেই ত এসেছি ।” রোগী বলিল, “তবে তাড়াতাড়ি দেখে নিন ; বেশী *८ेी করলে চলবে না ; তার আসার সময় হয়ে এল!” বিস্মিত ডাক্তার বলিল, “কে আসবে ?” শিরাবহুল রক্তহীন হাতখানা মাড়িয়া ডাক্তারকে কাছে ডাকিয়া গলা নামাইয়া অতি সন্তপণে রোগী বলিল, “যামিনী, ঘামিনী।” হরিহরের পুরাতন কৌতুহল জাগিয়া উঠিল। সে ব্যগ্র হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “যামিনী কে ?” বিরক্তিতে রোগীর কুঞ্চিত ললাট রেখায় রেখায়-ভরিয়া উঠিল। সে বলিল “কে ? সেই ত সব। দেখে বুঝতে পাব্ছ না! তার ঘর তার বাড়ীর মত লাগছে না ? এ কি এক দিনের কাজ ? কত দিন কত বৎসর ধরে তিল তিল করে সঞ্চয় করেছি, শরীরের বিন্দু-বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়েছি, তবে না আজ এর এত রূপ । বল না ডাক্তার, তার মনে ধরবার মত কি হয়নি?” হরিহর কিছু না বুঝিয়াই বলিল, “হয়েছে।” রোগীর মুখে মান হালির ক্ষীণ একটি রেখা ফুটিয়া উঠিল। সে প্রবাসী—আষাঢ়, ১৩৩১ [ ২৪শ ভাগ, ১ম খণ্ড বলিল, “তবে, তবে আর দেরী কেন ? আর কি এখনো এ-রঙ্গ, এ-খেলা ভাল দেখায় ? ভুল করেছিলাম বটে, আমিই প্রথমে; তাই বলে কি চিরকালই এমনি লুকোচুরি খেলে আমায় যন্ত্রণা দিতে হবে ? কে জানে, মেয়ে মানুষের মন এতে কি আনন্দ পায় ? কিছুতেই বেঁধে রাখতে পারলাম না! রাজার মেয়ে সে, দরিদ্রের ঘরে দুঃখ পাবে এই ভয়েই না তখন আনতে চাইনি। রাজরাণীর মত ঘর সাজাতে একটু সময় লাগে বৈকি! তাতেই কি অমনি অভিমান করতে হবে ? আর আজ যে এত সাধনা করছি, এর কি কোনোই মূল্য নেই ? মুখের কথায় যখন কিছুতেই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না, তখন ভেবেছিলাম খাচার পার্থীর মত বন্দী করে তাকে ধরে রাখব। বাড়ীর চারিধারে পাচিল দিলাম, পাচ হাত উচু করে’। ডাকাতে পারে না এ পচিল পার হতে, কিন্তু সে তাও এড়িয়ে গেল । তার পর যত ঘরে যত দরজা যত জানালা ছিল, সব পেরেক ঠুকে একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি। দেখতেই পাচ্ছ কেবল আসা যাওয়ার পথটুকু রেখেছি মাত্র । কিন্তু সে বিদ্যুতের আলো বাধতে পারলাম না। সারাদিন বাড়ীয় ঘুরে ঘুরে দেখি কোথায় ফাক আছে কি না, দোর জানাল টেনে টেনে দেখি কোথাও আলগা হ’য়ে গেছে কি না, কিছুই ত বুঝতে । পারি না ।” হরিহর বলিল, “যদি তাকে রাখতেই পারেননি, তবে আর বৃথা কষ্ট করেন কেন ?" রোগী হাসিয়া বলিল, “সে কি কম মায়াবিনী ? আমাকে পাগল করতে সে প্রতিরাত্রে আসে। অন্ধকার ঘরে আসে, দূর থেকে কথা কয়, আবার আলো না হতেই কোথায় চলে যায়, হাওয়ার সঙ্গে যেন মিলিয়ে যায়। একবার চোখের দেখাও দেয় না । তার পর তন্ত্র তয় পাতি পাতি করে খুঁজেছি, কোথাও তাকে পাইনি। কোন পথে সে আসে তাও জানি না, কোন পথে যায় তাও বলতে প্লারি না। অন্ধকারে যখন সমস্ত বাড়ী ছেয়ে যায় তখন ঢুকুবার জন্যে খিড়কীর বাগানের দরজা একটিবার খুলে রাখি বটে, কিন্তু সে আনুবার পর কতদিন বেরিয়ে গিয়ে দেখেছি দুয়ারে ভিতর থেকে তালা বন্ধ।”
পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১১
অবয়ব