পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আষাঢ় ও শৃঙ্খল অজয় পকেট হাত ড্রাইমা তিনআনার পয়সা বাহির করিল, বলিল, “আজ প্রতিজ্ঞ যখন ভেঙেছি, ভালো করেই ভাঙব। এই তিন আনা আছে, নাও। ইচ্ছে না করলেও দুটিখানি মুখে দিয়ে এসো। পরীক্ষাটা হয়ে যাক, তারপর যতগুলি উপোস কোরো।” নন্দ বলিল, “পয়সা ত আমার কাছেই আছে।” অজয় বলিল, “ঠিক বলছ ?” নন্দ বলিল, “আপনি ত জানেন, আমি মিথ্যে কপনো বলি না।” অজয় বলিল, “তা জানি। তবে আব খেতে যাওনি কেন ? যাও, খেয়ে এসো।” নন্দ কিছুক্ষণ স্তন্ধ হইয়া রহিল। অজয়ের মনে হইল, সে দাড়াইয়া দাড়াইয়া টলিতেছে । হঠাৎ অজয়ের পায়ের কাছে মাটিতে সে বসিয়া পড়িল, অস্ফুট-কণ্ঠে কহিল, “আপনিও ত আজ তিন দিন রাত্রে খেতে যাননি—” বাকী যাহা বলিবার ছিল তাহার গলায় বাধিয়া গেল, অজয়ের পাশে বিছানায় মুখ গুজিয়া উচ্ছ্বসিত আবেগে ফুলিয়া ফুলিয়। সে কাদিতে লাগিল। অজয় বাধা দিতে চেষ্টা করিল না, বাধা দিবার শক্তি আজ নিজের ক্লান্ত দেহমনের মধ্যে খুজিয়া পাইল না। বাহিরে বর্ষ নামিয়াছে। নীরবে নন্দের পাশে মাটিতে নামিয়া বসিয় তাহার মাথাটিকে সে কোলে টানিয়া লইল, তারপর নীরবেই তাহার চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে লাগিল। রাত্রি বহিয়া চলিল। ধূলি-সমাচ্ছন্ন আদ্র ভূমিতল ছাড়িয়া উঠিবার কথা দুজনের কাহারও মনে হইল না। ভোরের দিকে অকস্মাৎ ঘুম ভাঙিয়া অজয় দেখিল, নন্দ মাটিতেই পড়িয়া ঘুমাইতেছে। অত্যন্ত নিদ্রাতুর চোখে তাহাকে একবার উঠতে বলিয়া নিজে কখন বিছানায় গিয়া গুইয়াছিল মনে নাই। ধীরে তাহার গায়ে হাত দিয়া ডাকিল, “নন্দ ” হঠাৎ গরম জলের কাংলিতে হাত ঠেকিলে যেমন হয় তেমনই ভাবে চমকিয় সে হাত সরাইয়া লইল, আবার সন্তপণে কপালে হাত রাখিয়া দেখিল, জরে নন্দের গা পুড়িয়া যাইতেছে। সভয়ে তাহাকে ঠেলা দিতে দিতে ডাকিল, “নন্দ, नन, ७ नन्ल !” ঘুম এবং জরের মোহ একসঙ্গে কাটাইবার চেষ্টা করিতে করিতে নন্দ বলিল, “কি ?” ●>一>> Ob-6 “বিছানায় উঠে শোও। শীগগির ওঠ। জরে গা পুড়ে যাচ্ছে যে একেবারে ” নন্দ বিছানার প্রান্তে উঠিয়া বসিল । তারপর কিছুক্ষণ বাম হস্তে দক্ষিণ হস্তের কজির কাছে নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করিয়া ঘুম-জড়ান চোখ ভাল করিয়া না মেলিয়াই একটু মৃদ্ধ হাসিল মাত্র। যেন ঠিক এইরূপ হওয়ারই কথা ছিল। আরও আগেই হয় নাই যে, সে কেবল অদৃষ্ট-দেবতাকে সে এতদিন গুছাইয়া ফাকি দিতে পারিয়াছে বলিয়া । অজয় বলিল, “আমারই জন্যে এই বিপদ ঘটুল। আমার উচিত ছিল তোমাকে বিছানায় তুলে শোওয়ানো।” নন্দ বলিল, “আপনার কি দোষ, বা রে! বিছানায় গুয়ে কি আর মানুষের জর আসে না ? অসুখটা ত আমার আছেই, যখন হয় এম্নি হঠাৎই ইয়।" অজয় বলিল, “ক’দিন থাকে ?” নন্দ বলিল, “তার ঠিক নেই কিছু, একদিনেও সেরে যায় আবার একুশ দিনও থাকৃতে পারে।” এমন ভাবে বলিল, ধেনু এক্ষেত্রে একে আর একুশে তফাৎ কিছু নাই । বাস্তবিক ছিলও না। পীড়িত, দুৰ্ব্বল, অনাহারক্লিষ্ট দেহে যে স্বথের জীবন তাহাকে দিনের পর দিন অতিবাহিত করিতে হইতেছে, তাহার উপর সামান্য একটু জরতপ্ততাকে এমন কিছু অসাধারণ বিপংপাত বলিয় তাহার মনে হইবার কথা নয়। আরও ছেলেবেলায় জর আসিলে এইজন্য সেটাকে তাহার দুর্ভাগ্য মনে হইত, যে, যতদিন জর থাকিবে, পেট ভরিয়া সে খাইতে পাইবে না। এখন ত এমনিতেই অধিকাংশ দিন খাইতে পায় না, স্বতরাং জর একটু আছে বা নাই তাঁহাতে আর এমন আসিয়া যাইবে কি ? বলিল, “পরীক্ষার জন্য ভাববেন না, পরীক্ষা আমি ঠিক দেব।” অজয় বলিল, “আচ্ছ, সে হবে এখন। সম্প্রতি তুমি শুয়ে পড় দেখি। দাড়াও, বালিশটা ঠিক করে দিচ্ছি ... এই দুটো চাদর এক সঙ্গে করে দিচ্ছি, গায়ে দাও ।...মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে, টিপে দেব ?” নন্দ ব্যাকুল ভাবে বলিলে, “না, ন, মাথায় তেমন কিছু কষ্ট হচ্ছে না।”