পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পশ্চিমের মনে তেমন কোনো সংশয় জাগাইয়া দিবে, তাহাও সম্ভব নয় । এ দেশীয় সংবাদপত্র-সমূহ যদিই বা নিতান্ত সচেতন নিরপেক্ষতার সহিত ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সংবাদ প্রচার করিত, তাহা হইলেও একটা প্রকাণ্ড বিপদ থাকিয়াই ষাইত। ইয়ুরোপের দেশগুলি আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়াই পরস্পরকে জানিয়া আসিয়াছে । স্বাদেশিকতা বা জাতীয় সঙ্কীর্ণতা প্রত্যেক দেশের যতই থাকুক না কেন, পশ্চিমের কোনো জাতি অন্য কোনো পাশ্চাত্য জাতিকে উপমানব বা সভ্যতার গণ্ডীর বাহিরে বলিয়৷ মনে করে না । ভারতবর্ষকে সেভাষে জানিবার স্থযোগ পশ্চিমের কোনো দিন হয় নাই। ইংলণ্ডের লক্ষ লক্ষ নরনারী যে-ভারতবর্ষকে কোনোদিন দেখিবার স্বযোগ পাইবে না, সেই ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নিজেদের কৌতুহল নিবৃত্তি করে নিজেদের কল্পনায় এক অভিনব ভারতবর্ষের স্বষ্টি করিয়া । সে কল্পিত ছবিতে বাঘ আছে, হাতী আছে, সাপ আছে, অৰ্দ্ধবিবস্ত্র অদ্ভুতাকৃতি অসভ্যেরা আছে ; সেখানে ভাষার সংখ্যা এত ষেশী যে কেহ কাহারও কথা বুঝে না ; ধৰ্ম্মের নামে সেখানে মানুষ বহুপ্রকার জানোয়ার ও বিবিধাকৃতি পুতুলের উপাসনা করে ; মারামারি, খুনোখুনি সেখানে চিরন্তন এবং শাস্তিরক্ষার্থ ব্রিটিশ-সৈন্তের উপস্থিতি সেখানে একান্ত প্রয়োজন ; সেই জঙ্গলময় বিরাট মহাদেশে মঙ্গলময় ব্রিটিশজাতি রেলগাড়ি স্থাপন করিয়াছে, শিক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছে, দেশরক্ষার স্ববন্দোবস্ত করিয়াছে , অকৃতজ্ঞ ভারতবাসী আজ স্বাধীনতার দাবি করিতেছে বটে, কিন্তু যে-মুহূৰ্ত্তে ব্রিটিশের প্রসারিত বাহু ভারতবর্ষকে রক্ষা করিতে ক্ষান্ত হইবে, সেই মুহূৰ্ত্তে অসংখ্য মাতুষ হিংস্রপশুর মত পাহাড় হইতে নামিয়া আসিয়া এতদিনের প্রতিষ্ঠিত শাস্তিরাজ্যকে একেবারে উৎসন্ন করিয়া ফেলিবে, আর সেই অবকাশে হয় রাশিয়া, নয় জাপান, নয় জাৰ্ম্মেনী গিয়া ভারতবর্ষকে নিজের কবলে আনিয়া সবলে এমন স্বশাসন আরম্ভ করিয়া দিবে যে, তখন ভারতবর্ষ ব্রিটিশ-শাসন ফিরিয়া পাইবার জন্য কাতর ক্রমদন আরম্ভ করিয়া দিবে , ইত্যাদি । * , * প্রবাসী—মাঘ,:১৩৩৭ তাই বলিতেছিলাম, ভারতবর্ষ সম্বন্ধে ইংলণ্ডের নরনারীর গোড়াতেই যে একটা ভুল ধারণা জন্মিয়াছিল, এই স্থদীর্ঘ দুই শত বৎসরে তাহ নিৰ্ম্মল না হইয়া দৃঢ়তর হইয়াছে। ভারতব সম্বন্ধে কোনে ফিল্ম দেখিতে যাও, দেখিবে সেখানে জঙ্গল আছে, হাতী আছে, অদ্ভূত পোষাকপর পাগড়ীসমেত দুই একটি মহারাজ আছেন, আর মাঝে মাঝে ছবিটিকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য শাড়ীপরা গহনায় ভারাক্রান্ত দুই একটি সাওতাল রমণীকেও হাজির করা হয় এবং তাহ হইতেই এখানকার রমণীরা ভারতীয় রমণীর রূপ ও রুচির নমুনা হাতে-হাতে পাইয়া পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেন। সংবাদপত্র খুলিলে দেখিবে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মাঝে মাঝে কিছু কিছু সংবাদ থাকে—যথা, একজন মুসলমান একজন হিন্দুর মাথ৷ ভাঙিয়াছে, একজন হিন্দু এক মুসলমানের বুকে পদাঘাত করিয়াছে, কোথাও হিন্দু-মুসলমানে খুনোখুনি আরম্ভ হইয়াছে এবং পুলিস বা সৈন্ত প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া বহুকষ্টে শাস্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার প্রয়াস পাইতেছে, কোথায় এক বঙ্গীয় যুবক কোন শ্বেতাঙ্গের উপর ঢ়িল ছুড়িয়াছে এবং অনতিবিলম্বে তাহাকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে, কোথায় কলিকাতার এক ক্ষুদ্র গলির একপ্রাস্তে একটি অন্ধকারময় ক্ষুদ্র কক্ষে চারিটি বোমা পাওয়া গিয়াছে এবং সেই উপলক্ষ্যে পুলিস বিশেষভাবে তদন্ত করিতেছে এবং অল্পমানে অনেককেই সন্দেহ করিয়া গ্রেপ্তার করিতে সমর্থ হইয়াছে, ইত্যাদি ; অথবা, হাজার হাজার লোকের করতালিধ্বনির মাঝখানে জনৈক মুসলমান নেতা প্রচার করিয়াছেন ষে, গান্ধীর মস্তিষ্কবিরুতি ঘটিয়াছে, মুসলমানরা কিছুতেই শাস্তিভঙ্গ করিতে রাজী হুইবে না এবং উগ্ৰপন্থীদের অন্যায় আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমস্ত মুসলমান-সমাজ একমত হইয়৷ শাস্তিস্থাপনে গভর্ণমেণ্টকে সাহায্য করিবার জন্য ব্যস্ত, ইত্যাদি ; অথবা, অস্পৃশ্বর অসহযোগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছে, এবং উৎপীড়ক হিন্দুসমাজের অপেক্ষ উদার ও নিরপেক্ষ ব্রিটিশ গভর্ণমেণ্টকেই যে তাহারা বড় বন্ধু বলিয়া মনে করে, তাহ যেন গান্ধীপ্রমুখ হিন্দুনেতারা বিশেষভাবে মনে রাখেন, ইত্যাদি।