পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬০ এখন এখানে কেমন ক'রে ?”— 'কেমন করে, তা তুমি কেমন করিয়া বুঝিবে রমেশ ? সে যে মায়ের প্রাণ। তুমি যে রোগ-শয্যায় পড়িয়া একবার 'মা' বলিয়৷ ডাকিয়া ফেলিয়াছ। আর কি মা থাকিতে পারে! পুত্র যদি বিপদে পড়িয়া একবার 'মা' বলিয়া ডাকে, তবে—অসীম ব্যবধানে থাকিয়াও মায়ের প্রাণ যে আপনি কঁাপিয়া উঠে। সে যে সংসারের সার স্থষ্টি-"মায়ের প্রাণ।" - বৃদ্ধ রমেশের পার্শে উপবেশন করিয়া তাহার পৃষ্ঠে হস্ত রাথিয়াবলিলেন—“বাবা, আজ একমাস যে তোর কোন খবর পাই নাই। প্রাণ তো আর বুঝ মানলে না— তাই ছুটে এলাম।” জর-তপ্ত হস্তদ্বয়ের মধ্যে মাতার হস্তথানি চাপিয়া ধরিয়া, নত মস্তকে করুণস্বরে রমেশ বলিতে লাগিল—“তা এসেছ বেশ করেছ মা। মা তুমি বড় আশা করে কাশী দেখতে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি সে কথা রাখতে পারি নি। চল মা এইবার তোমায় নিয়ে কাশী যাই । আর এখানে থাকব না। মা, তোমায় কষ্ট দিয়ে, তোমার উপর মিছে অভিমান করে মুখ খুজতে গিয়েছিলাম,–কিন্তু তার বেশ ফল পেয়েছি।” বলিতে বলিতে রমেশের কণ্ঠস্বর যেন রোধ হইয়া আসিতে লাগিল। বৃদ্ধ দুইহস্তে তাহাকে ক্রোড়ের মধ্যে টানিয়া লইয়া ভীত কম্পিত-স্বরে বলিলেন— "কেন ? কি হয়েছে বাবা! পাগলের মত তুই কি বকছিল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না –বোমাই বা গেলেন কোথায়! ঘরে এখনও আলো দেওয়া হয় নাই । ও বৌমা ! বেীমা ? রমেশের বুকের মধ্যে যেন একটা প্রবল ঝড় বহিতে লাগিল। সে মাতার ক্রোড়ে থাকিয়া কঁাপিতে কঁাপিতে বলিল—“অার কাকে ডাকছ মা ? এখানে কেউ নাই।" মাতা—“সে কি ? বোমা কোথায় ?" রমেশ–“সে আছে—কাশীর মণিকর্ণিকার ঘাটে । আগে বল মা, আমায় ঘৃণা করবে না। আমার উপর রাগ করবে না? তাহলে আমি সব কথা বলব।” বৃদ্ধ—“বাব সব কথা খুলে বল। তোর কথা শুনে আমার বড় ভয় হচ্ছে ।" রমেশ বলিতে লাগিল—“তবে শোন মা। তুমি কাশী ८बानौ–ोछार्छ, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড -- যেতে চেয়েছিলে। তোমায় ফাকি দিয়ে, তাকে নিয়ে আমি পশ্চিমে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অনেক জায়গা ঘুরেফিরে কাশীতে এসে তার কলেরা হল । অনেক চেষ্টাতেও তাকে আর বঁাচাতে পারলাম না । মা, জন্মের মত, তাকে কাশীতে ফেলে এসেছি। মা, তোমায় ফাকি দিয়ে হাতে হাতে তার সাজা পেয়েছি।" রমেশ মায়ের কোলে মুখ লুকাইয়া বালকের মত কঁাদিতে লাগিল। পুত্রের কথা শুনিয়া বৃদ্ধার প্রথমে ভ্রম হইতেছিল—সে বুঝি বিকারের ঘোরে বকিতেছে। তারপর অঞ্চলে চক্ষু আবৃত করিয়া ক্ৰন্দন-বিজড়িত-কণ্ঠে বলিলেন—“বাবা এক মাসের মধ্যে এত কাও হয়ে গেল, আমি তার কিছুই জানতে পারলাম না—” বুদ্ধা পুত্রকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়৷ ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। আজও–চন্দ্রকিরণ দিগন্ত উদ্ভাসিত করিয়া, উন্মুক্ত বাতায়নপথে রমেশের অণধার গৃহে আসিয়া প্রবেশ করিতেছে। বসন্তের মৃদু-হাওয়া দূর-অরণ্য-বাসী সাওতালদের বংশী-ধ্বনি আনিয়া রমেশের নীরব-কক্ষে পৌছাইয়া দিতেছে। সে বঁাশীর তান আজ বড়ই করুণ লাগিতেছিল। তদপেক্ষা অধিক করুণ লাগিতে ছিল—সেই পাৰ্ব্বত্যদেশের প্রায় পাদপশূন্য বিপুলায়তন ভূখণ্ডমধ্যস্থ রেলওয়ে ষ্টেসনের বিশ্রামাগারের কোন বাঙ্গালী যাত্রীর মধুর কণ্ঠের বাঙ্গলাগান,— “—আর ত কেউ চাইলে না ফিরে, নিশার অাধার এলো ঘিরে ;– শেষে মনে হল মায়ের কথা - নয়নের জলে ৷" - রমেশ ঠিক মাতৃক্রোড়ের শিশুর মতই কাদিতে লাগিল। আর বৃদ্ধ তাহার মাতৃ-হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ ঢালিয়া তাহাকে সম্বন দিতে লাগিলেন । মাতাপুত্রের", এই দারুণ শোকের দৃশু দেখিতে আর কেহই ছিল না। কেবল দেওয়াল-গাত্রে রমেশ ও বিমল্লার একখানি প্রতি চ্ছবি সংলগ্ন ছিল—চেয়ারে উপবিষ্ট রমেশের পাশ্বে দাড়াইয়৷ বিমলা। বিমলা যেন রমেশের কানে কানে বলিতেছিল“তুমি আজ মা চিনিয়াছ দেখিয়া আমি মারিয়াও সুখী হইলাম। আমার শেষ কথা, জীবনে কখনও মাতৃস্নেহে সন্দি হান হইও না। মাতৃস্নেহে কৃত্রিমতা নাই। মাতৃ-বাক্য T s ২য় সংখ্য। ] ഹം - আশীৰ্ব্বাদ জ্ঞানে সৰ্ব্বদা নতশিরে মানিয়া চলিবে। মায়ের 'aালে ব্যথা দিও না। তাকে স্বর্থী করিতে প্রাণপণ চেষ্ট করবে। তাহ হইলে নিজেও স্বর্থী হইতে পারিবে।” রমেশ মায়ের প্রাণে প্রাণ মিশাইয়া, ঠিক দুঃছেলের মত কাদিয়া কাটিয়া পরিশান্ত হইয়া মায়ের কোলেই | | ঘুমাইয় পড়িল । শ্ৰমনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায় । সেখ আন্দু (*) লতিকা নিজের ঘরে আয়নার সম্মুখে দাড়াইয়া চুলগুলা ঘুরাইয়। ফিরাইয়া গুছাইয়া লইতেছিল। পাশে হেলান কেদারায় লাবণ্যময়ী জ্যোৎস্ব শুইয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিল। উভয়েই বেড়াইবার বেশভূষায় সজ্জিত। ' লতিকার রূপরাশি রৌদ্রালোকের ন্যায় তীব্র উজ্জল, জ্যোংস্কার সৌন্দৰ্য্য স্নিগ্ধ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার ন্যায় মনে৷ রুম, লম্বিক ঈষৎ খৰ্ব্ব ও স্কুল, জ্যোংস্ক একহারা অথচ অল্প দীর্ঘাকার ; জ্যোংস্কার মুখভাব রমণীয় কোমলতাব্যঞ্জক, লতিকার মুখভাব নারী-দুলভ দস্তমণ্ডিত ; জ্যোৎস্ন। শাস্তু, লতিক চঞ্চল । কেশপ্রসাধন সমাধা করিয়া লতিকা ফিরিয়া দাড়াইল । টেবিলের ফুলদানী হইতে মাল-ছড়াটি তুলিয়া হাতে জড়াইতে লাগিল। জ্যোংশ্ন কাগজখান। রাথিয়া সহস্যে বলিল “স্বয়ম্বরে নাকি ?” বক্রহস্যে লতিকা বলিল “স্বয়ং আছি, বর কই ?” দ্বারের পদ সরাইয় পরিমল ঘরে ঢুকিল, “গাড়ী হয়েছে।" পরিমল লতিকার ভ্রাত। জ্যোৎস্ন হাসিল, "ধও তৈরী।" লতিকা গম্ভীর হইয়া বলিল "অভাব যা, রথীর!” চতুর্দশ বর্ষীয় বালক, তাহদের রহস্য বিদ্রুপের মৰ্ম্ম বুঝিল না, পরিমল নিজের জামার সামনেদিকটা ঝাড়িম্বা দিয়া, নিশ্চিন্তু মুখে বলিল—“আন্দু সাহেব রয়েছে”—জামাটা টানিয়া পুনরায় সোজা করিল। পরিমলের নিবৃদ্ধিতায় জ্যোৎস্ব হাসিল। লতিকা সকোপ কটাক্ষে বলিল “হতভাগা ছেলে !" সেখ আন্দু ২৬১ জ্যোৎস্ব বলিল “আহা, গাল দিও না, ও সারধি মনে করেছে। চল, এস।” গালি খাইয়া পরিমলের রাগ হইল, বলিল “আমি • যাব না—“ জ্যোৎস্ব তাহাকে অনেক করিয়া ভুলাইয়৷ লইয়৷ চলিল , সিড়িতে নামিতে নামিতে জ্যোৎস্ব বলিল "সরুপ কই?" লতিকা পশ্চাং হইতে ডাকিল "খুকি আয়।” "াই”—বলিয়া খুঁকি ওরফে সরসী, একাদশবৰ্ষীয় দীণকায় সুন্দর বালিকা এলোচুলে ফিতা বাধিয়া, সাদ ফ্রক ইজের পরিয়া, পড়িবার ঘর হইতে চুটিয়া আসিল । সরসী চৌধুরী-সাহেবের মধ্যম কন্যা, ভাগলপুর ইস্কুলে পড়ে। বেশ শান্ত শিষ্ট মেয়েটি। সরসীর পিছনে পিছনে জামা জুতা পরিয়৷ টুপী হাতে সমীরণও ছুটিয়া আসিল, সমীরণ চৌধুরী-সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র, সপ্তমবর্ষীয় বালক । সমীরণকে দেখিয়া লতিকা দাড়াইল, বিরক্ত হইয়া বলিল “এই হয়েছে! তুমিও ! তোমায় আমি নিয়ে যাব না, যাও ফিরে যাওঁ ৷” দিদির ধমকে থতমত খাইয়। সে দাড়াইল ; দিদিকে সবাই ভয় করিত। সরসীর ইচ্ছা তাহাকে লইয়া যায়, কিন্তু দিদির মুখের উপর প্রতিবাদ করিবার সাহস তাহার ছিল না, সে করুণদৃষ্টিতে জ্যোৎস্নার পানে চাহিল। জ্যোৎস্ন। কিন্তু তৎপূৰ্ব্বেই বলিল “আহ আহুক আহক, জামা জুতো পরে এসেছে।" লতিকা তাড়না করিয়া বলিল "আস্কক পরে এক পাল ছেলে নিয়ে আবার বেড়াতে যায় !" জ্যোংস্ক সমীরণের হাত ধরিয়া টানিয়া অগ্রসর হইল, মুছম্বরে বলিল “আমরা তো কারে বাড়ীতে যাব না, শুধু গঙ্গার ধারে ধারে একটু বেড়িয়ে আসব, একে নিয়ে যেতে দোষ কি ?” লতিকা আর কথা কহিল না। সকলে গাড়ীর দিকে অগ্রসর হইল। ফটকের সামনে প্রাঙ্গণে, মোটরগাড়ী রহিয়াছে। গাড়ীর ওপাশে, মাটিতে জাহ পাতিয়া আন্দু একটা লোহার ভারি রেঞ্চ লইয়া গাড়ীর ক্ষুণ্ডলা কসিয়া, ঠুকিয়া, দেখিয়া লইতেছিল। গাড়ীর উপর দাড়াইয়া -