পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অণশ্বিন ভিক্ষু অভিরাম কিন্তু উত্তেজিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন, ঠিক! ঠিক! শিলালিপিতে যে এ-কথার উল্লেখ আছে— মনে নেই ? শিলালিপিতে ভূমিকম্পের উল্লেখ কোথায় আছে স্মরণ করিতে পারিলাম না। ভিক্ষু তখন বোলা হইতে শিলালেখের অনুলিপি বাহির করিয়া উল্লসিত স্বরে কহিলেন, *আর সন্দেহ নেই বিভূতি বাবু, আমরা ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি।—এই গুইন। বলিয়া তিনি মূল প্রাকৃতে লিপির সেই অংশ পড়িয়া শুনলেন—কথিত আছে যে, অস্তুরদেশীয় দৈত্যগণ দেবপ্রিয় ধৰ্ম্মাশোকের কালে হিমালয়ের ম্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশে ইহা নিৰ্ম্মাণ করিয়াছিল। মনে পড়িয়া গেল। ‘স্পন্দনশীল জঙ্ঘাপ্রদেশ কথাটাকে আমি নিরর্থক বাগাড়ম্বর মনে করিয়াছিলাম, উহার মধ্যে যে ভূমিকম্পের ইঙ্গিত নিহিত আছে তাহা ভাবি নাই । বলিলাম, ‘হঁ্য, আপনি ঠিক ধরেছেন, ও-কথাগুলো আমি ভাল ক'রে লক্ষ্য করি নি। এ-জায়গাটাও বোধ হয় শিলঙের মত ভূমিকম্পের রাজ্য—’ এই সময় মোড়লের দিকে নজর পড়িল । সে হঠাৎ ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে, ক্ষুদ্র তিৰ্য্যক চক্ষু জলজল করিয়া জলিতেছে, ঠোট দুটা যেন কি একটা বলিবার জন্য বিভক্ত হইয়া আছে। তার পর সে আমাদের ধাধা লাগাইয়৷ পরিষ্কার প্রাকৃত ভাষায় বলিয়া উঠিল, ‘শ্রবণ কর। স্বৰ্য্য ঘে-সময় উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রের দ্বিতীয় পাদে পদার্পণ করিবেন সেই সময় বুদ্ধস্তম্ভের রন্থ পথে স্বৰ্য্যালোক প্রবেশ করিয়া তথাগতের দিব্যদেহ আলোকিত করিবে, মন্ত্রবলে স্তম্ভের দ্বার খুলিয়া যাইবে। উপযুপিরি তিন দিন এইরূপ হইবে, তার পর এক বৎসরের জন্য দ্বার বন্ধ হইয়া যাইবে। হে ভক্ত শ্রমণ, যদি বুদ্ধের অলৌকিক মুখচ্ছবি দেখিয় নিৰ্ব্বাণের পথ সুগম করিতে চাও, এ কথা স্মরণ রাখিও। এক নিশ্বাসে এতখানি বলিয়া মোড়ল হাপাহঁতে লাগিল । তীব্র বিশ্বয়ে ভিক্ষু বলিলেন, ‘তুমি—তুমি প্রাক্লত ভাষা জান ?" মোড়ল বুঝিতে না পারিয়া মাথা নাড়িল। তখন ভূটানী সহচরের সাহায্য লইতে হঠল। দোভাষী চন্দন-মুভি " هم سوج প্রমুর্থাৎ মোড়ল জানাইল, ইহা তাহাদের কৌলিক মন্ত্ৰ ; পুরুষপরম্পরায় ইহা তাহদের কণ্ঠস্থ করিতে হয়, কিন্তু এই মন্থের অর্থ কি তাহা সে জানে না। আজ ভিক্ষুকে ঐ ' ভাষায় কথা কহিতে শুনিয়া সে উত্তেজিত হইয়া উহা উচ্চারণ করিয়াছে। আমরা পরস্পর মুখের পানে তাকাইলাম। ভিক্ষু মোড়লকে বলিলেন, “তোমার মন্ত্র আর একবার বল |’ মোড়ল দ্বিতীয় বার ধীরে ধীরে মন্ত্র আবৃত্তি করিল। ব্যাপারটা সমস্ত বুঝিতে পারিলাম। এ মন্ত্র নয়—বুদ্ধস্তম্ভে প্রবেশ করিবার নির্দেশ । বৎসরের মধ্যে তিন দিন সূৰ্য্যালোকের উত্তাপ রন্ধ পথে স্তম্ভের ভিতরে প্রবেশ করিয়া সম্ভবত: কোন যন্ত্রকে উত্তপ্ত করে, ফলে যন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত দ্বার খুলিয়া যায়। প্রাচীন মিশর ও আসীরিয়ায় এইরূপ কলকব্জার সাহায্যে মন্দিরদ্বার খুলিয়া মন্দিরের ভণ্ড পূজারিগণ অনেক বুজ রুকি দেখাহত—পুস্তকে পড়িয়াছি স্মরণ হইল। এই স্তম্ভের নিৰ্ম্মাতাও অস্থর—অর্থাৎ আসাঁরীয় শিল্পী ; সুতরাং অমুরূপ কলকজার দ্বারা উহার প্রবেশদ্বারের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নয়। যে-শ্রমণগণ বুদ্ধ-মূৰ্ত্তি লইয় এখানে আসিয়াছিল তাহারা নিশ্চয় এ রহস্ত জানিত ; পাছে ভবিষ্য বংশ ইহা ভুলিয়া যায় তাই এই মন্ত্র রচনা করিয় রাখিয়া গিয়াছে । কিন্তু মোড়ল এ মন্ত্র জানিল কিরূপে ? তাহার মুখখানা ভাল করিয়া দেখিলাম। মুখের আদল প্রধানত: মঙ্গোলীয় ছাচের হইলেও নাসিক ভ্র ও চিবুকের গঠন আৰ্য্য-লক্ষণযুক্ত। শ্রমণগণ ফিরিয়া যাইতে পারে নাই ; তাহাদের দশ জনের মধ্যে কাহারও হয়ত পদস্খলন হইয়াছিল। এই মোড়ল সেই ধৰ্ম্মচু্যত শ্রমণের অধস্তন পুরুষ—পূৰ্ব্বপুরুষের ইতিহাস সব ভুলিয়া গিয়াছে, কেবল শূন্যগর্ভ কবচের মত কৌলিক মন্ত্রটি কণ্ঠস্ত করিয়া রাখিয়াছে। চমক ভাঙিয়া স্মরণ হইল বৎসরের মধ্যে মাত্র তিনটি দিন স্তম্ভের দ্বার খোলা থাকে, তার পর বন্ধ হইয়া যায়। সে তিন দিন কবে ? কতদিন দ্বার খোলার প্রত্যাশায় বসিয়া থাকিতে হইবে ? -