পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তৃষিত আত্মা শ্ৰী জগদীশচন্দ্র গুপ্ত সীতাপতি মারা গেলেন বড় হঠাৎ । খামার-বাড়ী হইতে বেলা অনুমান সাড়ে এগারটার সময় বাড়ী ফিরিয়া মণ্ডপ-ঘরে তক্তপোষের উপর বসিয়া যখন তিনি ভূত্যকে তামাক দিতে বলিলেন তখনো তার শরীরে বাহিক কোনো গ্লানি ছিল না, কিন্তু তামাক সাজিয়া আনিতে যে অত্যন্ত্র সময়টুকু লাগিল তাহারই মধ্যে দেহের কোথায় যে কি কাণ্ড ঘটিয়া গেল বোঝা গেল না। ভূত্যের হাত হইতে ইকাটি লইয়াই প্রথমে তার হাত, পরে সর্বাঙ্গ থর্থর করিয়া কঁাপিতে লাগিল। হস্তচু্যত হইয়া হুক পড়িয়া যায় দেখিয়া ভৃত্য তাড়াতাড়ি ছকটি লইয়া লোক ডাকিতে-ডাকিতে সীতাপতিকে ধরিয়া শুয়াইয়া দিল ; সীতাপতি অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। ইহার অল্পক্ষণ পরেই পুত্রপরিজন-পরিবেষ্টিত সীতাপতি স্বৰ্গারোহণ করিলেন । - যে বহুকাল রোগে ভুগিয়া-ভুগিয়া শয্যায় শুইয়া ক্রমে ক্রমে তিল তিল করিয়া ক্ষয় হইয়া প্রাণত্যাগ করে তাহার মৃত্যুতে তাহার অধিকৃত স্থানটিই কেবল শূন্ত হইয়া যায়—সে যেন নিশ্চিত এবং নিঃশেষ অনুপস্থিতি ; কিন্তু, যে-মানুষ এই ছিল এই নাই সে কাছে না থাকিয়াও কোথায় যেন থাকে ; তার অভাবে গৃহের প্রত্যেক কক্ষ, প্রত্যেক অঙ্গন, প্রত্যেক দ্বার,প্রত্যেক মোড়, প্রত্যেক অংশ,—গৃহের সমগ্র মৰ্ম্মস্থলটিই যেন শূন্ত হইয়া হা হা করিতে থাকে ; কিন্তু ঠিক সেই কারণেই আবার জীবিতের সচকিত ভীতির অন্ত থাকে না,— ঐ বুঝি সে আসনে বসিয়া, ঐ বুঝি সে দুয়ারে দাড়াইয়া, ঐ বুঝি তার কণ্ঠস্বর—এমনি ভুল সহস্ৰ বার ঘটিয়া মনোরাজ্যের সীমা ছাড়াইয়া মৃতের দৈহিক অস্তিত্বের -মৃণালটুকুর নিশ্চিহ্নরূপে ও নিঃশেষে নিস্ক্রান্ত হইয়া যাইতে বহু বিলম্ব ঘটে । এটা বোধ হয় সাধারণ । কিন্তু সীতাপতির অকস্মাৎ Nుళి=XR মৃত্যুর পর পুত্রবধু লক্ষ্মীর প্রাণে যে-আতঙ্কের সঞ্চার হইল তাহা যেমন দুঃসহ প্রবল তেমনি নিরেট অব্যক্ত ; তাহা মুখ ফুটিয়া পরের কাছে বলিবার নয়, নিজেরই মনের সঙ্গে সে-কথা লইয়া বুঝি তর্ক করাও চলে না। প্রথম রাত্রি তার নিৰ্ব্বিল্পেই কাটিল । দ্বিতীয় দিন স্বামী মন্ত্রোচ্চারণ করিয়া মৃৎপাত্রে বায়সভোজ্য ক্ষীরোদক দিতেছেন, তিন মাসের শিশুপুত্রটিকে কোলে করিয়া অদূরে বসিয়া উদকদান দেখিতে-দেখিতে লক্ষ্মীর সহসা আশ্চৰ্য্য দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়া গেল—সে দেখিল, উদকাধারের উৰ্দ্ধস্থিত বায়ু যেন জৈবিক একট। আকার ধারণ করিতে-করিতে একখানা স্বচ্ছ অথচ স্বম্পষ্ট মুখাবয়বে রূপান্তরিত হইয়া শূন্যে ভাসিতে লাগিল ; আর সে মুখখান— লক্ষ্মী সভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ফেলিল ; ক্রোড়স্থ শিশু কাদিয়া উঠিল ; পরক্ষণেই চোখ মেলিয়া লক্ষ্মী দেখিল মুখ অন্তর্হিত হইয়াছে। - ইহার পর দিনমান নিরুপদ্রবেই কাটিয়া গেল। কিন্তু লক্ষ্মীর প্রাণের উপর যে-ছায়াপাত হইয়াছিল সেটা মুছিল না। সন্ধ্যা, অজ্ঞাতলোকের সমস্ত প্রচ্ছন্নতার কুহকপীড়ন লইয়া ঘনাইয়া আসিল, আবছায় অন্ধকারের দিকে ভাল করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিতেও ভয়ে লক্ষ্মীর গা ভারি হইয়া উঠিতে লাগিল –পল্লী-আবাসের চতুর্দিকের অনিবিড় বিস্তৃত জঙ্গল অন্ধকারের বাধনে একাকার হইয়া ক্রমে জমাট কঠিন হইয়া উঠিল; তার উৰ্দ্ধেই আকাশের খানিকট নক্ষত্রের দুৰ্ব্বল আলোকে আর বাম্পের আবরণে রহস্যগভীর দীর্ঘদেহ নারিকেল, সুপারি প্রভৃতি গাছের শ্রেণীবদ্ধ মাথাগুলি দুলিয়া-জুলিয়া পাতায় পাতায় একটা সিবু সি শব্দ উঠিতেছে— যেন কাদের কাণে কাণে ফিস্ ফিস্ কথা। বাড়ীর উত্তর