পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& e সম্পদ চিরপ্তন করিবার জন্য মানুষ মেদিন অসম্ভবকে সস্তব করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। তাহার পর্বতকে কথা কহাইয়াছিল ; পাথরকে দিয়া গান গাওয়াইয়াছিল। পাহাড়ে, পৰ্ব্বতে, মরুভূমিতে, উষর নির্জন প্রদেশে এবং জনাকীর্ণ নগরীতে মানবের আশ অমর মুৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়াছিল। স্বষ্টির সেই বিপুল প্রচেষ্টা পথের বাধা-বিঘ্নকে গ্রাহ করে নাই, সকল বাধাবিন্ধকে দলিত করিয়া আপনার উদ্দেশ্ব সিদ্ধ করিয়াছিল, ভাবকে মুষ্ঠি দান করিয়া। প্রাচ্য মহাদেশের অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া এই যে একটা শক্তির থেলা সেদিন দেখা গিয়াছিল, আট কাহাকে বলে, এপ্রশ্নের উত্তর তাহ হইতেই পাওয়া যায়। যাহ! সৎ, যাহা সুন্দর, তাহার ডাকে মানবের স্বষ্টিপর তাঙ্কার যে-সাড়, তাহাকেই বলে আট। গান্ধার দেশে বুদ্ধের যে-সব প্রস্তর-মুক্তি পাওয়া গিয়াড়ে, সেগুলিতে আমরা গ্ৰীক শিল্পের প্রভাব দেপিতে পাই। ষ্টাছার মুৰ্বি-কল্পনায় এনাটমির বৈজ্ঞানিক দিক্‌টার উপরষ্ট জোর দিয়াছিলেন ; কিন্তু প টি ভারতীয় শিল্প বুদ্ধের আত্মাকে অভিব্যক্ত করিবার উপর,--ঠাইর অস্তরের ভাবের দ্যোতনার উপরই বেশী জোর দিয়াছে । বিখ্যাত ইউরোপীয় স্থপতি রেডিনের শিল্পের ভিতর আমরা কি দেখিতে পাই ? অপূর্ণতার বন্ধন হইতে মুক্ত হইবার জন্য অপূর্ণের সংগ্রাম ; পক্ষান্তরে প্রাচী স্বভাবতঃই অন্তর্দৃষ্টিপরায়ণ ; পূর্ণতার দিক হইতেই তাহার প্রেরণা আসিয়াছে। ভারতের শিল্পীরা অপরের নিকট হইত্তে যতই ধার করুন, তাহারা নিজেদের ঐ বিশিষ্টত। বজায় রাখিয়ছেন । প্রতিভায় যাহার বড় হইয়াছেন, তাহাদের বিশিষ্ট লক্ষণ একটি হইল—গ্রহণ করিবার অসাধারণ ক্ষমতী ; এই ধার লইবার সময় দুনিয়ার সভ্যতার বাজারে তাহার বে অপরিমিত সম্পদ ঋণ দিয়৷ রাখিয়াছেণ, এ-কথাও উহার জাত থাকেন না। যাহার মাঝারি গোছের, ধার করিতে লজ্জ বোধ করে,—ভয় পায় শুধু তাহারাই ; কারণ কিভাবে ধীর শোধ দিতে হয়, তাহ (র তlহ জানে 1 ইউরোপের চিস্তু, ইউরোপীয় সাহিত্যের ধার সাদরে বাংলা সাহিত্যে গৃহীত হইয়াছে, ইহা আমাদের পক্ষে আনন্দেরই বিষয়। ইউরোপীয় চিন্ত এবং ইউরোপীয় সাহিত্যের ধারা আমাদের মনের সংস্পর্শে আলিবার সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের অনেক পরিবর্তন সাধিত হইতেছে, কিন্তু আমাদের ভারতীয় আয়টি সেই বিপৰ্য্যয়ের ভিতর দিয়াও প্রবল প্রভাবে আপনাকে বাচাইয়া রাথিয়াছে। কোনো রকমে ভারতীয় আর্টের লেবেল বাহাতে জুড়িয় দেওয়া যায় এমন জিনিষ মাপিয়া-জুখিয়া দেখিয়া-শুনিয়া তৈয়ারী করিলেই হইল, এই যে যুক্তি, আমাদের শিল্পীরা যেন তাহ মালিয়। না লন । আর্ট গ্রহণও করতে পারে যেমন উদারভার সহিত, দ্বানও করিতে পারে তেমনি উদারতার সহিত। সকলেরই জন্ত তাহার আতিথেয়তা উন্মুক্ত। কারণ, তাহার মত পুরাতন হইলেও তাহার যে-সম্পদ, সে-সম্পদ কল্পলোকের ; তাহ। তাহার ণিজস্ব-তই নিত্যই নুতন। এই বিশ্ব স্বষ্টির মধ্যেই বিশ্বেশ্বর বাস করেন। মানুষের পারিপাশ্বিক অবস্থা, তাহার নিজের বাসস্থান, এ-ভাবে তৈয়ারী করা উচিত, যাহতে তাছা ভtণর আত্মার পক্ষে সঙ্গত হইতে পারে। শিল্পী যিনি, উহাকে আজ এই কথা ঘোষণা করিতে হুইবে যে, আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি। তূহকে আজ এই ঘোষণা করিতে হইবে যে,আমি বিশ্বাস করি আদর্শে। সেই আদর্শ পৃথিবীকে স্নিগ্ধ ধারায় অভিষিক্ত করিতেছে, স্বর্গের সেই ষে আদর্শ, তাই কেবল কল্পনায়ই বিলাস নয়, থেয়াল নয়—তাহাই পরম সত্য, তাহাতেই এই বিশ্বের স্থিতি, তাহাই বিশ্বের জীবন। সেই প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৩ [ ২৬শ ভাগ, ১ম খণ্ড আদর্শই আমাদের জীবন-বীণা ঝঙ্কার তুলে ; আর সেই ঝঙ্কার—সেই সঙ্গীতের স্বর ঢেউ তুলিয়া আমাদের আশা-আকাঙ্গাকে সীমা হইতে অসীমে লইয়া যায়। * ( বঁiশরী, ফাঙ্কণ ১৩৩২ ) শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তং সুন্দরং , কবির কথার প্রতিধ্বনি দিয়া আমি বলিতে চাই না-শাস্তুই স্বন্দর, সুন্দরই শাস্ত। আমি শুধু বলিব যে, সকল সৌন্দয্যের মধ্যে, সৌন্দর্ঘ্যের পরাকাষ্ঠী যাহ। তাছার মধ্যে অনিবাৰ্য্য উপাদানরূপে রহিয়াছে একটা নিবিড় শান্তি । বিশেষতঃ, আমার বক্তব্য শিল্প সৃষ্টি লইয়া-শিল্পের সৌন্দর্য্য-প্রকাশে বে-রকমেরই হউক না কেন, তাহার নিভৃত বলিয়াদ সৰ্ব্বদাই একটা মহাশান্তি। শিল্পের বাহিরের রূপায়ন যত বহুধা বিচিত্রই হউক, তাছাদের সকলের অস্তরের প্রতিষ্ঠ হইতেছে শাস্ত রসায়ন। শৃঙ্গারকে রসের আদি বলা হয়, কিন্তু তাহ বস্তু-হিসাবে, যে-হিসাবে স্থূল শরীর হইতেছে মানব-আধারের আদি-আয়তন। ভাবের হিসাবে, অন্তরাঞ্জার দিক দিয়া, আদি বা প্রথম হইতেছে শাস্ত রস । শান্ত রসই মুল রাগ। অস্তান্ত রস তাঁহাকে ধরিয়া, তাহার উপর নানা রাগিণীর বিচিত্র লাল খেলাইয়া তুলিয়াছে। প্রাচীনের সকল শিল্প-স্বষ্টির মধ্যে তাই দেপি কি-একট) গভীর শাস্তি নিহিত। প্রাচীন শিল্পীরা রচনা করিতে বসিয়াছিলেন অস্তরে এই তাটল শাস্তি লইয়!--তাহাদের কাজে কোথাও ত্বরার লেশমাত্র নাই । তাই দেখি, তাহারা যখন কিছু গড়িতে বসিয়াছেন, তখন তাহীদের হাত দিয়া এক-এক মহাভারত, রামায়ণ, ইলিয়দ বাহির হইয়া আসিয়াছে, পিরামিদ বরবদুর কোণারক মাথা তুলিয়া দাড়াইয়াছে। পঞ্চস্তরে আধুনিকের দিকে যপন দৃষ্টিপাত করি তখনই দেখি কিএকটা মত্ততা, চঞ্চল্য, অশাস্তি ইহাদের প্রেরণার মধ্যে তহিয়াছে, ইহাদের স্বষ্টিকে ভাঙ্গিয়া-ভাঙ্গিয়া ছোট ছোট করিয়া ছড়াইয় দিয়াছে, উদ্বেল উচ্ছ জ্বল করিয়া দিয়াছে। ইহাদের স্বষ্টি অল্পপ্রাণ। একটান কি বৃহৎ-কিছু গড়িতে ইহাদের ইচ্ছাও হয় না, সাহসেও কুলায় না। আধুনিক জগতে যে বিরাট বা বিপুল জিনিষ আদৌ স্বষ্টি হয় ন৷ তাহা বোধ হয় বলা যায় না। আমেরিকার এক-একটি গগনচুম্বী প্রসাদ (sky scrapet) কলেবর-হিসাবে পিরামিদ অপেক্ষ। ছোট হইবে না । আলেকজাদের জুমী (Alexander I}uinas) বত গ্রন্থ • লিখিয়াছেন কিম্বা খবরের কাগজের অনেক লেখক যত কথা লিখিতেছেন তাহা দেখিয়া যাশ্মীকির লজ্জার মাথা নত করা উচিত। আধুনিক শিল্পী বিপুলকে স্বষ্টি করিলেও করিতে পারেন, কিন্তু স্বষ্টি করিতে পারেন না বৃহৎকে । বিপুল হইতেছে ছোট-ছোট খণ্ড খণ্ড জিনিষের পুঞ্জ, আর বৃহৎ হইতেছে একটি গোটা বস্তুর অখণ্ড মহত্ব । আধুনিকের গৌরব অক্টারলোনী মনুমেন্ট-বড় জোর, “আর্ক দ" ত্রিয়োফ” (Are de Triomphe)—কিন্তু প্রাচীনের গৌরব গোট এক-একখানি পাথরের স্তম্ভ (nonolith), গোট একটা পাহাড় কুদিয়া তৈয়ারী মন্দির। মহাকাব্যের যুগ চলিয়। গিয়াছে, আমরা আধুনিকের বলিয়া থাকি । কারণ, এই মহাকাব্য রচনা করিতে প্রয়োজন চিত্তের মধ্যে যে অবসর, যে স্থৈৰ্য্য-ধৈর্য্য, ষে টান দম তাহ আধুনিকের নাই । গীতিকাব্য অল্প দমের রচনা, আর তাহ আমাদের চিত্তের চঞ্চলতার, প্রাণের মন্দগতির, মনের সীমাবদ্ধ দৃষ্টির সহিত বেশ মিল খায়।

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত বক্ততা ।