পাতা:প্রবাসী (ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬ষ্ঠ সংখ্যা ] ঘাটের সিড়ির কাছে আসিয়া ইন্দির। দেখিল, শিশু মেয়েটি প্রথম ধাপের উপরই পড়িয়া আছে। দিব্য সুন্দর দেখিতে ; হতভাগিনী মা তাহাকে ছেড়া ময়লা ন্যাকড়ায় জড়াইয়া এখানে ফেলিয়া গিয়াছে। এখনও মরে নাই, মাঝে মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে কাদিতেছে। ইন্দিরা ছুটিয়া গিয়৷ তাহাকে কোলে তুলিয়া লইল । তাছার শরীরের কোমল উত্তপ্ত স্পর্শে তাহার কান্না খামিয়া গেল, টুকুটুকে ঠোঁট দু’টি ফাক করিয়া সে খাদ্যের সন্ধান করিতে লাগিল । ইন্দিরার চোখে জল আসিয়া পড়িল । কে সেই হতভাগিনী যে সামাজিক দণ্ডের ভয়ে এমন সম্পদ পথের ধূলায় ত্যাগ করিয়া গেল ? সে নিজে ত একটি শিশুর জন্য প্রাণও দিতে পারিত, আর তাহারই মত কোন বৰ্মণী অনায়াসে সন্তানকে হত্যা করিতেও দ্বিধা করিল ! সে শিশুটিকে কোলে করিয়া বাড়ী ফিরিয়া চলিল। দাসীর দল আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিল না, একেবারে আৰ্ত্তনাদ করিয়া উঠিল, “করেন কি, ম ? ওর জাতজন্মের ঠিক নেই, ওকে কি ছুতে আছে ? আপনাকে যে প্রাচ্চিত্তির করতে হবে মা, তা না হ’লে কেউ হাতের জলও খাবে না ।” “ছোট ছেলে মেয়ে নিষ্পাপ, তাদের ছুলে কখনও জাত ষায় না,’ বলিয়৷ ইন্দির মেয়েটিকে লইয়া আপনার ঘরে ঢুকিয়া পড়িল । বাড়ীতে মহা হৈ চৈ পড়িয়া গেল । এরকম কাণ্ড কেউ কখনও চোখেও দেখে নাই, কানেও শোনে নাই । ইন্দিরা যে বাড়ীর গৃহিণী, তাহার প্রাপ্য যে একট। সম্মান আছে, এ কথা রাগের ঝোকে সকলে যেন ভুলিয়াই গেল । যাহার মুখে যা আসিল সে তাহাই বলিতে আরম্ভ করিল। ইন্দির। তাহাদের কথায় কান না দিয়া, উপরের ঘরে বসিয়া শিশুটির পরিচর্য্যা করিতে লাগিল । দেবেন্দ্র ভোরে উঠিয়া রেড়াইতে চলিয়া গিয়াছেন। তিনি না আস৷ পৰ্য্যস্ত সে কি করিবে, কিছু স্থির করিতে পারিতেছিল না। কিন্তু শিশুটিকে সে পথে পড়িয়া মরিতে দিবে না, ইহা সে স্থিরই করিয়া ফেলিল । লীলা এতক্ষণ ঠাকুরঘরের পূজার আয়োজনে ব্যস্ত দেবতার দান بخه د ছিল, তাহার কানে খবরট পৌছিল কিছু বিলম্বে । সে তাড়াতাড়ি ইন্দিরার ঘরে ছুটিয়া আসিল । দেখিল, ইন্দিরা শিশুটিকে এক টুকরা ফ্লানেলে জড়াইয়। কোলে লইয়া বসিয়া আছে। ব্যস্ত হইয়া বলিল, “করেছ কি, কাকীমা ? দু’দিন বাদে যজ্ঞ ক’রে ছেলে নিচ্ছ, আর এখন এই কণও ক’রে বসলে ? এখন আর কোনো বামুনে তোমার বাড়ী পা দেবে ? একঘরে না করে ত সেই ঢের । সমাজে যখন রয়েছ, তখন সমাজের বিধি এমন ক’রে ভাঙলে চলে ? প্রায়শ্চিত্ত করতে হ’বে তোমায়, তা না হ’লে হাতের জলও কেউ খাবে না।” ইন্দির বলিল, “ধন্ত তোমাদের সমাজের বিধি বাছা ! জোর ক’রে টাকার বলে গরীব মায়ের ছেলে ছিনিয়ে নিচ্ছিলাম, সেটা হচ্ছিল পুণ্য; আর অসহায় শিশু, যার জগতে কেউ নেই, তাকে তুলে এনেছি ব’লে আমার এত বড় পাপ হ’য়ে গেল যে, আমার হাতে কেউ জল থাবে না ।” - দেবেন্দ্রের সন্ধানে চারিদিকে লোক পাঠানে হইয়াছিল। তিনি এতক্ষণ পরে তাহদের সঙ্গে ফিরিয়া আসিলেন। ঘরের ভিতর পা দিয়াই অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ আবার কি ?’ লীলা র্তাহীকে দেখিয়াই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । ইন্দিরা দুই হাতে মেয়েটিকে দেবেন্দ্রের সম্মুখে তুলিয়া ধরিল । বলিল, “দেখ, দেবতার দান । সমাজের চোথে ত আমি এখন পাপী, তুমি কি বল ?” দেবেন্দ্র কোনো উত্তর দিলেন না। মৃদু হাসিয়া চুপ করিয়াই রছিলেন । নীচে মহা কোলাহল শোনা গেল। ব্যাপার কি দেখিবার জন্য দেবেন্দ্র নীচে নামিয় গেলেন । রায় পরিবারের কুল-পুরোহিত নীচে দাড়াইয়া । ক্ৰোধে ক্ষোভে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের প্রায় বাকুরোধ হইয়া আসিতেছিল। দেবেন্দ্রকে দেখিয়া তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “বেীমা দেখি ভয়ানক স্বাধীন হ’য়ে উঠেছেন ! এ কি-বকম ব্যবহার তার ? তিনি প্রায়শ্চিত্ত না করলে আমি আর এবাড়ীর ছায়াও মাড়াব না।”