পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফাস্তুন টাকার লোভ, পাওন-দেনার কাজ যেখানে চলে, সেখানকার বাতাস বিষিয়ে ওঠে । সেখানে ওঁরা থাকেন ন। কাজেই এখানে দা-কুড়ুল হাতে করলেই দেবতারা এসে হাত থেকে কেড়ে নেন—কানে চুপি চুপি এমন কথা বলেন যাতে বিষয়সম্পত্তি থেকে মন অনেক দূরে চলে যায় । দেখিলাম রাজু কবি বটে, দার্শনিকও বটে। বলিলাম—কিন্তু রাজু, দেবতারা এমন কথা বলেন না যে বাড়ীতে খরচ পাঠিও না, ছেলেপুলে উপোস করুক। ওসব কথাই নয় রাজু, কাজে লাগো। নইলে জমি কেড়ে নেব । আরও কয়েক মাস গেল। রাজুর ওখানে মাঝে মাঝে যাই । ওকে কি ভালই লাগে ! সেই গভীর নির্জন লবটুলিয়া বইহারের জঙ্গলে এক ছোট একটা ঘাসের খুপরিতে সে কেমন করিয়া দিনের পর দিন বাস করে, এ আমি ভাবিয়া উঠিতে পারি না । সত্যকার সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক রাজু। অন্ত কোন ফসল জন্মাইতে পারে নাই, চীন ঘাসের দানা ছাড়া । সাত আট মাস হাসিমুখে তাই খাইয়াই চালাইতেছে। কারও সঙ্গে দেখা হয় না, গল্পগুজবের লোক নাই, কিন্তু তাহাতে ওর কিছুই অক্ষুবিধা হয় না, বেশ আছে। দুপুরে যখনই রাজুর জমির ওপর দিয়া গিয়াছি, তখনই দুপুর রোদে ওকে জমিতে কাজ করিতে দেখিয়াছি। খুপরিতে পড়িয়া ঘুম দিতে দেখি নাই যদিও পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বয়সের বৃদ্ধকে রোদের সময় ঘুমাইতে দেখিলেও বিশেষ কিছু দোষ দিতে পারিতাম না। সন্ধ্যার দিকে ওকে প্রায়ই চুপ করিয়া হরীতকী গাছটার তলে বসিয়া থাকিতে দেখিয়াছি— কোন দিন হাতে খাতা থাকে, কোন দিন থাকে না । কিন্তু ওর দুঃখ ইহাতে দূর কি করিয়া হইল, বুঝিতে পারিলাম না। রাজু যে ফসল পায়, ওর নিজের থাইতেই কুলায় না। পরিজনবর্গ যে কি খাইবে এ যেন আমারই ব্যক্তিগত চিন্তার বিষয় হইয়া উঠিল। এক দিন বলিলাম— রাজু, আরও কিছু জমি তোমায় দিচ্ছি, বেশী ক’রে চাষ কর, তোমার বাড়ীর লোক ন-খেয়ে মসবে যে ! রাজু অতি শাস্ত প্রকৃতির লোক, তাহাকে কোন কিছু বুঝাইতে ११--३ অণরণ্যক ՆՏՊ বেশী বেগ পাইতে হয় না। জমি সে লইল বটে, কিন্তু পরবর্তী পাচ-ছ মাসের মধ্যে জমি পরিষ্কার করিয়া উঠিতে পারিল না। সকালে উঠিয়া তাহার পূজা ও গীতাপাঠ করিতে বেলা দশটা বাজে, তার পর কাজে বার হয়। ঘণ্টা-দুই কাজ করিবার পরে রায় খাওয়া করে, সারা দুপুরটা খাটে বিকাল পাচটা পৰ্য্যন্ত। তার পরই আপন মনে গাছতলায় চুপ করিয়া বসিয়া কি ভাবে । সন্ধ্যার পরে আবার পূজাপাঠ আছে। সে-বছর রাজু কিছু মকাই করিল, নিজে না খাইয়া সেগুলি সব দেশে পঠাইয়া দিল, বড় ছেলে আসিয়া লইয়া গেল। কাছারিতে ছেলেটা দেখা করিতে আসিয়াছিল, তাহাকে ধমক দিয়া বলিলাম—বুড়ো বাপকে এই জঙ্গলে এক ফেলে রেখে বাড়ীতে বসে দিব্যি ফুৰ্ত্তি করছ লজ্জা করে না ? নিজেরা রোজগারের চেষ্টা কর না কেন ? সেবার গুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে কুশী নদীর জলে সৰ্ব্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই। এক দিন শুনিলাম রাজু পাড়ে সেখানে চিকিৎসা করিতে বাহির হইয়াছে। রাজু পাড়ে যে চিকিৎসক তাহা জানিতাম না। তবে আমি কিছু দিন হোমিওপ্যাথি ওষুধ নাড়াচাড়া করিয়াছিলাম বটে, ভাবিলাম এই সব ডাক্তার-কবিরাজশূন্ত স্থানে দেখি যদি কিছু উপকার করিতে পারি। কাছারি হইতে আমার সঙ্গে আরও অনেকে গেল। গ্রামে পৌছিয়া রাজু পাড়ের সঙ্গে দেখা হইল। সে একটা বাটুয়াতে শিকড়-বাকড় জড়ি-লুটি লইয়া এ-বাড়ী ও-বাড়ী রোগী দেখিয়া বেড়াইতেছে। আমায় নমস্কার করিয়া বলিল—হজুর । আপনার বড় দয়া, আপনি এসেছেন, এবার লোকগুলো যদি বঁাচে । এমন ভাবটা দেখাইল যেন আমি জেলার সিবিলু সার্জন কিংবা ডাক্তার গুডিভ চক্রবর্তী। সে-ই আমাকে সঙ্গে করিয়া গ্রামে রোগীদের বাড়ী ঘুরাইয়া লইয়া বেড়াইল। রাজু ওষুধ দেয়, সবই দেখিলাম ধারে। সারিয়া,