পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৬৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ՆՀՏ2 প্রবাসী SN983 দেবেশ হাসিয়া বলে, “কেন ? আবার কিসের তুক ?” অভিমান করিয়া অঞ্জলি আর কিছু বলে না, চুপ করিয়া যায়। কিন্তু পরের দিন খাচাসমেত সাদা পায়রা হাজির হয়, তাহাতে বাধা হয় না । আর ভাবে মলয়া । গুইতে গেলে হাতের মাদুলিগুলি শরীরে বেঁধে—গলার মাদুলিগুলি স্বর্ণহারের সংস্পর্শে কিরূপ একটা শব্দ করে। এক-এক বার সে ভাবে, এগুলি ছিড়িয়া ফেলিয়া দিই, কিন্তু আবার একটা ক্ষীণ আশা তাহাকে বাধা দেয়, মাদুলিগুলি ছিড়িয়া ফেলিবার সাহস আর তাহার হয় না। স্বামী কাজকৰ্ম্ম সারিয়া কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার পিঠের উপর মুখটি রাখে, কিছুক্ষণ কি ভাবে—সে-সব ভাবনার মধ্যে অঞ্জলির বলা অনেক কথা মনে পড়ে—আবার পাশ ফিরিয়া একটা বালিশ প্রাণপণে মুক্ত বক্ষে চাপিয়া ধরে। সকালে ঘুম ভাঙে—কি সব স্বপ্ন রাত্রে দেখিয়াছে মনে পড়ে—দুর্গার নাম স্মরণ করিয়া সে দরজা খুলিয়া বাহির হয় । অঞ্জলির বার-বার তাগাদ এবং প্রচুর বিশ্বাস, এই দুইটি জিনিষই মলয়াকে এমন করিয়া দিয়াছিল যাহার ফলে তাহার মাদুলি-ধোওয়া জল থাইতে ভুল হয় না— পায়রাটিকে সযত্বে খাবার দেয়—কাৰ্ত্তিকের ছবিখানার নীচে মাথা নীচু করিয়া নমস্কার করিতে হয়। . এখন এসব তাহার সহিয়া গিয়াছে। মলয়া এখন এসব যন্ত্রচালিতের মত করিয়া যায়। অঞ্জলিরও দিন দিন বিশ্বাস কমিয়া আসিল । সেদিন রাত্রে যখন দেবেশ অঞ্জলির কানে কানে বলিল, “কি গো লুকিয়ে লুকিয়ে সন্ন্যাসীর ওষুধ খেয়েছিলে নাকি ?” তখন লজ্জায় অঞ্জলির গাল রাঙা হইয়া উঠিল । আনন্দোম্ভাসিত সলঙ্গ চক্ষে সে স্বামীকে তিরস্কার করিয়া বলিল, “ষাও তুমি তার বেহায়া।” দেশে একটা টােক মারিয়া বলে, “তাই বটে।" , কিন্তু দুই মাস পরে মলয়াও জানিল । আনন্দে তার মন নাচিয়া উঠিল। অঞ্জলির মাতাকে সে চিঠি লিখিল— “কাকীমা ! অঞ্জলির ছেলে-হবে ফাত্তন মাসে ।” আর সত্যই ফান্ধনে অঞ্জলির একটি ছেলে হইল । অঞ্জলির কষ্ট দেখিয়া মলয়ার বড় কষ্ট হইয়াছিল—সে স্বামীকে বলিল, “ষাও টাকার জন্তে ত ভাবনা নেই। ও দাই দিয়ে হবে না । এক জন পাস-করা মিডওয়াইফ নিয়ে এস।” পাস-করা মিডওয়াইফ আসিল এবং সকল কষ্টের লাঘব হইল পুত্রমুখদর্শনে । অাতুড়ের মধ্যেই মলয়া ছেলেটাকে চুমা খাইতে লাগিল। পাস-করা দাই বলিল, “আমন করবেন না । এখন ওদের একটুতেই কিছু হতে পারে।” মলয়া বলে, “আমি ষে আর থাকতে পারছি না ।” জ্ঞান হইলে কাতর বিবর্ণ মুখে কাতর চক্ষে চাহিয়া অঞ্জলি বলিল, “দিদি কি হয়েছে ?” মলয়া উচ্ছসিত হইয়া বলিল, “সোনার চাদ হয়েছে, আমার বুকছুড়োনো মাণিক হয়েছে—এই দেখ ।” বিনা কারণে আজ মলয়ার চোখের জলে গাল ভাসিয়া গেল। সকলে ভাবিল, ও আনন্দে আজ আত্মহারা । প্রস্থতির সকল ঝঞ্চাট মিটিয়া গিয়াছে। রাত্রে ঘরে থাকিবার লোক ঠিক হইয়াছে, তবুও পাশের ঘরে স্থান করিয়া মলয়া বলিল, “আমি এইখানে গুলাম অঞ্জলি— দরকার হ’লে ডেকো ” অঞ্জলি বলিল, “আচ্ছা।” গুইয়া গুইয়া আজ মলয়ার কেমন যেন মনে হইতে লাগিল, এই রক্তমাংসে গড়া একটি পুতুল—ও আজ অঞ্জলির ছেলে-ও বড় হইবে—অঞ্জলিকে মা বলিয়া ডাকিবে । অঞ্জলি ওকে বুকে জড়াইয়া ধরিবে, স্তন্ত দিয়া ওর শরীর পুষ্ট করিবে, স্তন্যপানরত শিশুর বিচিত্র কলম্বরে অঞ্জলির প্রতি রক্তকণা মাচিয়া উঠিবে—আনন্দে স্নেহাতিশষ্যে তাহার বৃক্ষ বাহিয়া তাহার মাতৃত্বের মমতার ধারা নামিয়া আসিবে ঐ শিশুর প্রতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পূর্ণ করিয়া তুলিতে। আজ অঞ্জলি মা হইয়াছে। একটি শিশুর মনোরাজ্যের উপর তাহার সম্পূর্ণ অধিকার। মলয়া আর ভাবিতে পারেন, দুই হাতে বুকটা চাপিয়া ধরে। ঠিক সেই সময়ে নবশিশু কেমন যেন শব্দ করে । চমকিয়া ধড়ফড় করিয়া মলয় বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া ডাকে, “অঞ্জলি” ।