পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভিনেতা শ্ৰীআৰ্য্যকুমার সেন সন্ধ্যার অন্ধকারে পুকুরপাড়ে একাকী বসিয়া সিগারেটের পর , সিগারেট ধ্বংস করিতেছিলাম ও আকাশপাতাল ভাবিতেছিলাম। দেবীপক্ষ শেষ হইয়া গিয়াছে ; কালীপূজার কয়েক দিন আগে । কৃষ্ণপক্ষের আকাশে চাদ নাই, কিন্তু তারার আলোয় ধরণীকে অস্পষ্ট আলোকিত করিয়া রাথিয়াছে, মসীকৃষ্ণ হইতে দেয় নাই । আমার চিন্তার কারণ খুব বেশী গুরুতর নহে। কালীপূজার সময় গ্রামের ড্রামাটিক ক্লাব কর্তৃক মহাসমারোহে দুইখানি যুগান্তকারী নাটকের অভিনয় । নাটক দুইখানি হয়ত যুগান্তকারী হইতে পারে, অথবা না-হইতেও পারে, কিন্তু অভিনয় যাহা হইবে, তাহাকে ঠিক যুগান্তকারী, এমন কি দিনান্তকারীও বলা যাইবে কিনা, সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে । তাহার কারণ আবশ্ব ইহা নহে, যে, আমাদের গ্রামের সখের থিয়েটারের দল অত্যন্ত আনাড়ী এবং অভিনয় সম্বন্ধে অজ্ঞ । আমাদের গ্রামে, বিশেষ করিয়া আমাদের বাড়ীতেই, জনকয়েক বেশ ভাল অভিনেতা আছেন, এবং আমিও নাকি তাহাদের মধ্যে স্থান পাইতে পারি। অবশু, নিজের মুখে একথা না বলিলেই হয়ত শোভন হইত। - কিন্তু আসল বিপদ এই ষে, আমাদের গ্রাম দীর্ঘকায় -লোকের গ্রাম। এখানকার সখের থিয়েটারে নায়কের ভূমিকায় সুপুরুষ অভিনেতা মিলে, গুণ্ডার ভূমিকার জন্ত ভীষণদর্শন লোকেরও অতাব নাই। যাহা মিলে না, তাহা স্ত্রীভূমিকা অভিনয় করার লোক। আমি নিজে পাচ ফুট দশ ইঞ্চি মানুষ হইয়া পাচ ফুট সাড়ে-এগার ইঞ্চি নায়িকার সৃহিত প্রেম করিলে অভিনয় কি প্রকার জমিবে, • সে-বিষয়ে একটু আশঙ্কান্বিত হইয়া উঠিয়াছিলাম, এবং বিশেষ করিয়া এই কথাটাই এই স্তন্ধ সন্ধ্যায় নির্জন আকাশতলে আমাকে ভাবাই তুলিয়াছিল। কিন্তু এমন কঠিন চিন্তাও আমার মনকে বেশী ক্ষণ আটকাইয়া রাখিতে পারিল না। কারণ শহরের লোক আমি, বৎসরাস্তে একবার বড়জোর গ্রামে আসি, পুকুরপাড়ে গভীর কালে জলের পাশে বসিয়া দূরের অসংখ্য খেজুর ও নারিকেল গাছ, বিস্তীর্ণ বঁাশঝাড়, হেমন্ত-সন্ধ্যার নিস্তব্ধতার সহিত, দূর আকাশের তারার সহিত, পুকুরের ওপাড়ে যে মেয়েটি ছায়ার মত মাটির কলসীতে জল ভরিতেছে, সেই ছল ছল শব্দের সহিত, মিলিত হইয়া মে মায়া রচনা করিতেছিল, তাহা হইতে নিস্কৃতি পাওয়ার শক্তি আমার খুব বেশী ছিল না। শুধু ভয় হইতেছিল, এখনই কে আসিয়া পড়িবে, আমার পল্লীস্বপ্ন এক মুহূর্বে ভাঙিয়া যাইবে । নিজের গ্রামকে এ দৃষ্টিতে আগে কখনও দেখি নাই । আমার মনে হইল, এই বিস্তীর্ণ বাড়ী, এই পুকুর, বাগান, দূরের অদৃশ্ব ধানক্ষেত, সমস্ত জিনিষে আমার অংশ রহিয়াছে, আমি এই পশ্চিমের বাড়ীরই সস্তান । জলের উপর আবছা অন্ধকারে যে সাদা রঙের নাল ফুল ফুটিয়া পুকুরের অবিচ্ছিন্ন কালোকে স্বল্প শুভ্রতা দিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি পাপড়ি, অতি স্বন্ধ রেণুটুকুতে পৰ্য্যস্ত আমি অধিকারী, এ সকলের সহিত, এই বাড়ীর সম্পর্কিত দৃশুঅদৃপ্ত সমস্তকিছুর সহিত, আমার অতীত, আমার বর্তমান, আমার অনাগত ভবিষ্যৎ, সমস্ত ওতপ্রোত। ইচ্ছা করিয়া দূরে সরিয়া গেলেও ইহারা আমাকে ছাড়িবে না, অথবা ইহাদের উপর আমার অধিকার এক বিন্দুও কমিবে না । আমার জীবনের উষাকালে আমি ইহাদের সহিত পরিচিত হই নাই, বাংলাদেশের বাহিরে, সাওতাল-পরগণার এক শহরে প্রথম পৃথিবীর আলো দেখিয়াছিলাম। আমার জীবনের এই ক্ষণস্থায়ী বর্তমান আমি নগরের মায়ায় কাটাইতেছি, দুঃখিনী পল্লীর সহিত ক্ষণিকের পরিচয়