পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ёва; 皇 করিয়া আবার তারাকে ভুলিয়ানগরের প্রখর আলোকে দিকভ্রান্ত পতঙ্গের মত যৌবনের সকল উদ্যম, সকল শক্তি ডালি দিতেছি। আবার হয়ত জীবনের গোধূলিতে, যখন পল্লী, নগর, সারা পৃথিবীর মায়া কাটাইয়া বিদায় লওয়ার জন্য প্রস্তুত হইব, তখনও হয়ত খুলনা জেলার এই ক্ষুদ্র গ্রামটির পশ্চিম কোণের এই লাল রঙের বাড়ী, এই চণ্ডীমগুপ, ঠাকুরঘর, বাহিরে স্থলপদ্ম ও শেফালি ফুলে ভরা এই বৃহৎ বাগান, এই ভাঙা পুকুরপাড়, কালো জলের উপর কলমীশাক, নালফুল—ইহাদের কেহ আমার জাগ্ৰং মনের একটি ক্ষুদ্রতম অংশও অধিকার করিয়া থাকিবে না । আমার পচিশ বৎসর বয়স পর্য্যস্ত যাহাকে নিতান্ত স্বল্পপরিচিত, ক্ষণিকের খেলাঘরের সাথী বলিয়া মনে করিয়াছি, আজ মনে হইল সে আমার জীবনের, আমার মৃত্যুর, আমার নিদ্রা এবং জাগরণের প্রধানতম বন্ধু, আমার নিতান্ত আপনার জন, আমি পথভ্রান্ত, প্রবাসী। জানি, এ গ্রাম ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ-বছরের মত গ্রামের স্মৃতি মুমার মন হইতে বিদায় লইবে, যেমন করিয়া আমার পচিশ বছর বয়স পৰ্য্যস্ত লইয়াছে। কিন্তু ইহার আগে কি কখনও নিঃসঙ্গ পুকুরপাড়ে ভাঙা সিড়ির উপর কৃষ্ণনবমীর দিন বসিয়া আকাশপাতাল চিন্তা করিয়াছি ? হয়ত না ! নায়েব-মহাশয়ের ঘর’ হইতে তারস্বরে নিজের নাম উচ্চারিত হইতে শুনিয়া বুঝিলাম, রিহাসালের সময় হইয়াছে ; এবং এখনই নিজের অপেক্ষা দেড় ইঞ্চি দীর্ঘতর এক ব্যক্তিকে নায়িক কল্পনা করিয়া অত্যন্ত গভীর ও কাব্যতাবপূর্ণ প্রেমের অভিনয় করিতে হইবে। মন বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। মনের ভিতর হইতে কে যেন বলিল, “রিহাসাল ত রোজই রহিয়াছে, আজিকার মত স্বপ্নমায়াপূর্ণ সন্ধ্য আর তুমি কবে পাইবে ? যাহার ডাকিতেছে, তাহারা ডাকুক, কিন্তু তোমার আজ এক পাকিতে হইবে, শুধু আজিকার সন্ধ্যা ; দূরে চলিয়া যাও, ধেখান হইতে কাহারও চীংকার তোমার,কানে ঢুকিবে ন৷ ” মন বাহা বলিল, সম্পূর্ণ বিচার-বিবেচনা রহিত হইয়া তাহাই করিয়া বসিলাম। কিন্তু কয়েক মুহূৰ্ত্ত ভাবিলে অভিনেতা “ጎዬግ বুঝিতে পারিতাম, যাহা করিতেছি, তাহা অত্যন্ত, বিপজ্জনক, ও চরম বুদ্ধিহীনতা । একাকী সেই অন্ধকার সন্ধ্যায় গাঢ় বনভূমির ভিতরের সঙ্কীর্ণ পথরেখা ধরিয়া অগ্রসর হইলাম। কত ক্ষণ চলিয়াছিলাম খেয়াল ছিল না, সহসা মনে হইল আধ ঘণ্টা আন্দাজ হাটিয়াছি । এত ক্ষণ চলিলে কতকগুলি পরিচিত বাড়ী চোখে পড়া উচিত, তাহারা যথাস্থলে রহিয়াছে কিনা দেখার জন্য পকেট হইতে ছোট টচটি বাহির করিলাম, এবং সভয়ে দেখিলাম, পথ ভুল করিয়াছি। যে-পথ দিয়া আসিয়াছি, সেখান হইতে দিনের বেলায় চেষ্টা করিলে হয়ত বাড়ী ফিরিতে পারিতাম, কিন্তু পল্লীর সহিত আমার যে স্বল্প পরিচয়, তাহা লইয়া এখান হইতে ঠিক পথ খুজিয়া বাহির করিয়া বাড়ী ফেরা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ব্যাপার । সেই ক্ষুদ্র টর্চটিকে সম্বল করিয়া ফিরিলাম, এবং আবার প্রায় আধ ঘণ্টা চলিবার পরও যখন পরিচিত কিছু চোখে পড়িল না, তখন বুঝিলাম, পথ হারাইয়াছি। শহরের লোক আমি, এত দিন রাত্রির নিজস্ব মূল্য তাহাকে দিই নাই। নগরী রাত্রিতে বিলাসিনীর মত আলোকমালায় দেহ সাজাইয়া সেই আবরণে নিজের রূপের দৈন্ত লুকাইয়া রাখে। এইটুকু শুধু সেখানে দিব ও রাত্রির প্রভেদ । কিন্তু রাত্রি নয়টার সময়ে রাস্তার উপরে সেখানে আমরা উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠি না, সে উৎকণ্ঠ সঞ্চার করিবার ক্ষমতা তাহার নাই। কিন্তু এই বনানীবেষ্টিত পল্লীর আছে । ভীতু ছেলে যাহাদের বলে, আমি সে-রকম নই। কিন্তু যেটুকু দৈহিক ও মানসিক সাহস এত দিন পর্য্যাপ্ত" বলিয়া মনে করিয়া আসিয়াছি, দেখিলাম, সমস্ত সৰল করিয়াও আমি একান্তভাবে নিঃসহায় । অনেক ক্ষণ জলিয়া আলোর শেষরশ্মিটুকুও নিবিয়া গেল। এই বিরাট অন্ধকারে, গভীর বনের মধ্যে দাড়াইয়া মনে হইল, এশুধু অকৃতজ্ঞ পুত্রের উপর পুল্পীমাতার প্রতিশোধ । এত দিন ধরিয়া যাহার স্নেহ উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছি, তাহার কঠোর তিরস্কার অন্ততঃ খুব উপেক্ষণীয় বলিয়া মনে হইবে না, তাহা সে জানে ।