পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

११३. ছিল, পল্পীর অৰ্দ্ধশিক্ষিতা গরিবের ঘরের মেয়ে যেমন ইরিয়া ভালবাসিতে পারে, তেমনই করিয়া। তাহার কলঙ্ক সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছি তাহা সত্য হউক বা মিথ্য হউক, কিছু আসিয়া যায় না। তাহার রুগ্ন মুখের দিকে চাহিয়া বুঝিতে দেরি হয় না যে তাহার অবশিষ্ট জীবন বৎসর বা মাস দিয়া গণনা করার প্রয়োজন নাই, বড়জোর কয়েকটি দিন বাকী। মনে হইল এই অসহায়া দুঃখিনী মেয়েটির জীবনে যদি কয়েক ঘণ্টার সামান্ত আনন্দও দিতে পারি, তবে সে আনন্দ তাহার জীবনের অবশিষ্ট অতি অল্প কয়টি দিনের চরম দুঃখকেও ছাপাইয়া উঠিবে। আমার ও স্বনীলের মুখের সাদৃশ্বটুকু সারদাবাবুর চোখে ধরা পড়িয়াছিল, কিন্তু তিনি তফাৎও বুঝিয়াছিলেন। এই রুগ্ন মেয়েটি তাহার অন্তর দিয়া শুধু সাদৃশুই গ্রহণ করিয়াছে, তাহার এই অসহ আনন্দের মুহূৰ্ত্তটিকে চূর্ণ করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না । সাগ্রহে আমার হাতদুখানি বুকের উপরে লইয়া অশ্রদ্রদ্ধ কণ্ঠে মীরা কহিল, “এত দিন তুমি কেন আমাকে ত্যাগ ক’রে ছিলে, একবারও কেন এলে না ?” কহিলাম, “এই ত এসেছি মীরা !” সে তেমনই করিয়া বলিতে লাগিল, “কিন্তু এত দিন ? আমি কত চিঠি লিখেছি, একখানারও কোন জবাব দাও নি কেন ?” উত্তর দিবার বিশেষ কিছু ছিল না। আমি শুধু তাহার রুক্ষ চুলের রাশির মধ্যে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলাম । - মীরা কহিল, “আমি বুঝতে পারছি, আমি স্বপ্ন --খেছি, সত্যি কখনও এত সুখের হতে পারে না—অন্ততঃ আমার জীবনে না।” বলিলাম, “না মীরা, তুমি স্বপ্ন দেখছ না, আমি সত্যিই ফিরে এসেছি ।” * অনুভব করিলাম, আমার দুই চোখ জলে ভরিয়া t - সারদাবীৰু ঠিক এক ভাবেই পিছনে দাড়াইয়া ছিলেন। ফিরিয়া, অত্যন্ত অন্যায় এবং অত্যন্ত অসঙ্গত ভাবে তাহাকে আদেশ করিলাম, “আপনি ঘুমোন গে যান।” প্রবাসী $N983 সত্যসত্যই বিনা বাক্যধ্যয়ে তিনি চলিয়া গেলেন। বোধ হয় ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাত দেখিয়া , তিনি এতটা হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন, যে, প্রতিবাদ করার, অথবা কৈফিয়ং চাওয়ার ক্ষমতাটুকু পৰ্য্যন্ত র্তাহার অবশিষ্ট ছিল না । অভিনয় আরম্ভ করিলাম। অভিনয় করিয়া কখনও এত তৃপ্তি পাই নাই, অথবা কোন শ্রোতাকে এত তৃপ্তি দিতে পারি নাই । হয়ত আমার সে অভিনয় অতি নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। হয়ত নীতিশাস্ত্র ও সমাজবিধি অনুসারে আমি কঠিন অপরাধে অপরাধী। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই। হয়ত ভগবানের চোখেও আমার অপরাধের মার্জনা নাই। কিন্তু আমার মনের গড় এক নীতিশাস্ত্র আছে, যাহা চলিত প্রথার সহিত মিলে না। তাহা আমার কাছে সাধারণ নীতি, সমাজবিধি এ সকলের অনেক উপরে, এবং তাহার চোখে, আমার নিজের মনের চোখে, আমি নিরপরাধ। ইহাই আমার কাছে যথেষ্ট । § সেই গভীর রজনীতে, জীর্ণ ক্ষুদ্র ঘরে, লন্ঠনের ক্ষীণ আলোয় এক মৃত্যুপথযাত্রী শ্রোতার সম্মুখে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করিয়া চলিলাম। নিতান্ত সরল ও স্বাভাবিক। শ্রোতার একবারও মনে হইল না, ইহা মিথ্যা, ইহার মধ্যে সত্যের লেশমাত্র নাই। অনেক প্রকার কল্পিত নায়িকার সহিত অনেক প্রেমের অভিনয় করিয়াছি, কিন্তু এই বাস্তব অভিনয়ের সহিত তাহাদের তুলনা হয় না। মীরা জিজ্ঞাসা করিল, "আচ্ছা, তোমার এ বউ খুব সুন্দরী, না ?” বলিলাম, “ছি: মীরা, ও কথায় আমি কষ্ট পাই, জান ?” আমি যাহাতে কষ্ট পাই, মীরা তাহ প্রাণ গেলেও করিতে পারিবে না । মীরা দ্বিতীয় বার ওকথা মুখে আনিল না। কহিল, “আজকের রাত্রি আমি ঘুমুব না । তোমাকেও ঘুমুতে দেব না। আমার মনে হচ্ছে, আজ আমার জীবনের শেষ রাত। আজকে তুমি সমস্ত ক্ষণ আমার কাছে থাকবে, সমস্ত ক্ষণ ।”