পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব ঐবিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় জীবনের মূলে যারা বাসা নেয়, তাদের আমরা অনেক সময়ে ভুলে থাকি। আমরা ভুলে থাকি আকাশের তারাকে, বনের ফুলকে—তবুও তারা প্রাণের নিঃশ্বাসবায়ুকে স্বমধুর করে, ভুলের শূন্ততাকে স্বর দিয়ে ভরিয়ে রাখে। এমন যে জ্যোতিৰ্ম্ময় স্বৰ্য্য—সেও ত অনেক সময়ে আমাদের চেতন-মনের বাহিরে থাকে । কিন্তু এই ভুলে থাকার নাম ত ভোলা নয়। স্বৰ্য্য আর তারা আর ফুল বিস্মৃতির মৰ্ম্মে বসে আমাদের রক্তে দেয় নিরস্তর দোলা। পৃথিবীতে যা-কিছু বিরাট, যা-কিছু সুন্দর, যাকিছু প্রাণস্পর্শী—তাদের সান্নিধ্যে যখনই আমরা আসি, তখন থেকেই তারা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, আমাদের সত্তা থেকে তাদের আর পৃথক ক’রে দেখতে পারি নে। বাহিরের কোন কিছুকে অবলম্বন ক’রে তাদের স্মরণ করতে যাওয়া এক হিসাবে প্রকাও একটা ভুল । বঙ্কিমের গগনস্পশী প্রতিভাকে স্মরণ করতে যাওয়ার মধ্যে এই রকমের একটা ভুল অাছে। আমাদের জীবনের ঠিক কোনখান থেকে তার প্রভাব মুরু হয়েছে— তা আবিষ্কার করা কঠিন। বাতাসের সঙ্গে যেমন ফুলের গন্ধ মিশে থাকে, বঙ্কিম তেমনি ক’রেই মিশে আছেন আমাদের কৈশোরের অসংখ্য স্বপ্নের সঙ্গে । চাদের আলোয় ঠাকুরমার মুখ থেকে রূপকথার গল্প শোনাকে যেমন জীবনের প্রভাত থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ক'রে দেখতে পারি নে, তেমনি বঙ্কিমকেও আমাদের জীবন-প্রভাতের সহস্ৰ স্বতি থেকে বিচ্ছিন্ন ক'রে দেখবার কোন উপায় নেই। সেই অতীতের অফুট চালোকে জেগে আছে বালক প্রতাপ আর বালিকা শৈবলিনীর ছবি, ভরা গঙ্গায় দু-জনে সাতার কেটে চলেছে পাশাপাশি । প্রতাপ ভুবছে আর মৃত্যুভয়ে শৈবলিনী ফিরে আসছে কুলে। সেখানে জাগছে কাপালিকের খড়গ এবং তার রক্তচক্ষুর পার্থে বন্দী 2 *-t নবকুমারের মান মুখচ্ছবি । সেই বাল্যের আলোঅন্ধকারে-মেশা জগতে কপালকুণ্ডলার অপূৰ্ব্ব রমণীমূৰ্ত্তি কাপালিকের খড়গ দিয়ে নবকুমারের লতাবন্ধন ছেদন করছে। বন্দীর সেই মুক্তির আনন্দ কি আমাদের কৈশোরের সহস্ৰ আনন্দের সঙ্গে মিশিয়ে নেই ? সেই আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিশোর-বয়সের কল্পনায়ু চোখ দিয়ে দেখা ফেনিল, নীল, অনন্ত সমুদ্র যার পটভূমিতে বিশাল চক্ষুর স্থির দৃষ্টি নবকুমারের মুখে ন্যস্ত ক’রে নির্নিমেষলোচনে দাড়িয়ে আছে নিরাভরণা অনিন্দ্যমুন্দরী কপালকুণ্ডলা। সপ্তগ্রামের নিবিড় অরণ্য-পথে একাকিনী কপালকুণ্ডলা যেখানে ঔষধের সন্ধানে চলেছে, সেখানে ভয়মিশ্রিত আনন্দের মধ্যে কিশোর-হৃদয়ের কল্পনাকে আশ্রয় ক’রে আমরাও বারম্বার তার সাথী হয়েছি। পরিশেষে অনন্ত গঙ্গাপ্রবাহের মধ্যে কপালকুণ্ডলার নিষ্কলঙ্ক জীবন যেখানে বিলুপ্ত হয়ে গেল আমাদের কিশোর-মনের শূন্ততার হাহাকারের মধ্যে, সেখানকার অশ্রুসজল স্বতি অতীতের আরও বহু স্মৃতির বেদনার সঙ্গে কি মিশিয়ে নেই ? আমাদের ছেলেবেলার কল্পনাকে বঙ্কিম যেমন ক’রে নাড়া দিয়েছেন, এমন ক’রে তাকে নাড়া দিয়েছে আর কে ? বিদ্যুদীপ্তি-প্রদর্শিত পথে অশ্বান্ধঢ় জগতসিংহ গড়মান্দারণের পথে চলেছেন একাকী। প্রবল বৃষ্টিধারার মধ্যে সেই নিঃসঙ্গ রাজপুত্রের ছবিকে কল্পনা ক’রে আমাদের বাল্যজীবনের কত মূহূৰ্ত্ত ভয়ে, বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। জনহীন প্রাস্তরে শৈলেশ্বরের মন্দিরে বর্ষাধারী জগৎসিংহ, অবগুষ্ঠিতা তিলোত্তম, শ্বেতপ্রস্তর-নির্মিত শিবমূৰ্ত্তি আর চতুরা বিমলাকে নিয়ে আমাদের কৈশোরের স্থতির সঙ্গে আজও অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে । * আমাদের কল্পনার জগৎ বঙ্কিমের মানসপুত্র আর মানসকন্তগণের দ্বারা পরিপূর্ণ। •সেখানে স্বন্দরী তিলোত্তম