পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৮৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈজ ঘুরে বেড়িয়েছে।. আমরা চেয়েছি নিৰ্ব্বাণ নিজের আত্মার কল্যাণ কামনা ক’রে । নিৰ্ব্বাণের উপর জোর দিতে গিয়ে বাস্তবের সমস্তাগুলিকে করেছি উপেক্ষা । আমাদের বেদাস্ত সাংখ্যাদি দর্শনগুলি আমাদের চিত্তকে বহির্জগতের সমস্তাগুলি থেকে সরিয়ে এনে তাকে করেছে অস্তমুখী। আমরা রুদ্ধদ্বার দেবালয়ের কোণকে করেছি আশ্রয় এবং বৃহৎ জগতের বিশাল চঞ্চল জীবনধারাকে করেছি অস্বীকার । ফলে এসেছে দেশব্যাপী নিশ্চেষ্টত । কৰ্ম্মশক্তি ক্রমে ক্রমে পঙ্গুত্ব লাভ করেছে। ইহজগতে আমাদের বঁাচার মধ্যে এই সঙ্কীর্ণতার প্রকাশ দেখতে পাই - পারিবারিক জীবনের প্রতি আমাদের অত্যধিক আসক্তির ভিতরে । আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বঁাচতে শিখিয়েছি কেবল পরিবারের মঙ্গলের প্রতি দৃষ্টি রেখে। দেশাত্মবোধ, জাতীয় স্বাধীনতা–এসব আইডিয়া আমাদের হৃদয়ে কখনও প্রাধান্ত লাভ করে নি । সাধারণ লোক ক্ষেতে থামারে কাজ করেছে, অবসর-সময়ে সতরঞ্চ , দাবা আর দশ-পচিশ খেলেছে, জমিদারকে খাজনা দিয়েছে, শানাইয়ের স্বরের মধ্যে ছেলের বউ এনেছে আর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ী পাঠিয়েছে, সদলবলে মেলায় গিয়ে সংসারের নিত্যব্যবহার্ষ্য জিনিষ কিনেছে, ছিপে মাছ ধরেছে, কামারবাড়ীতে গিয়ে দা আর বঁটি গড়িয়েছে, খামারের ধান গোলায় তুলেছে, সন্ধ্যায় সঙ্কীৰ্ত্তনের রোলের মধ্যে দিবসের দুশ্চিন্তাকে ভুলেছে, উঠানে বেগুনের আর লঙ্কার চারা পুতেছে, পুকুরে মাছ ছেড়েছে, দোলের দিনে রং খেলেছে, রাত জেগে যাত্রা শুনেছে, পৌষ-সংক্রাস্তির দিন পিঠাপুলি খেয়েছে, গ্রামস্থদ্ধ লোক পৌষল্যায় আনন্দে মত্ত থেকেছে, জ্ঞাতিশত্রুর বিরুদ্ধে উৎসাহের সঙ্গে দল পাকিয়েছে এবং সাধ্যমত সর্বপ্রকার বিপদকে সযত্বে এড়িয়ে চলেছে । দেশের স্বাতন্ত্র্য থাকল আর গেল—এ নিয়ে কখনও তারা মাথা ঘামানো প্রয়োজন মনে করে নি। কোন রাজার আবির্ভাব ঘটল আর কোন রাজার-তিরোভাৰ ঘটল এ-চিন্তা কোনো দিনই তাদের মনকে নাড়া দেয় নি। “ভারতকলম্ব” প্রবন্ধে বমি লিখেছেন: যখনই সময়লক্ষ্মীর কোপদৃষ্টিপ্রভাবে হিন্দু রাজা বা হিন্দু বঙ্কিমচত্বের প্রভাব هی سواه সেনাপতি রণে হত হইয়াছে, তখনই হিন্দুসেন রণে ভঙ্গ দিয়া পলায়ন করিয়াছে, আর যুদ্ধে সমবেত হয় নাই। কেননা, অল্প কাহার জন্ত যুদ্ধ করিবে ? যখনই রাজা নিধনপ্রাপ্ত বা অস্ত কারণে রাজ্যরক্ষায় নিশ্চেষ্ট হইয়াছেন, তখনই হিন্দুযুদ্ধ সমাধা হইয়াছে। আর কেহ তাহার স্থানীয় হইয়া স্বাতন্ত্র্য পালনের উপায় করে নাই ; সাধারণ সমাজ হইতে অরক্ষিত রাজ্য রক্ষার কোন উদ্যম হয় নাই । সাধারণ সমাজ হইতে অরক্ষিত রাজ্যরক্ষার কোন উদ্যম হয় নাই—এই খানেই বঙ্কিম আমাদের অধঃপতনের মূল কারণটি আবিষ্কার করেছেন। আমাদের কল্পনা ওপারে ঘুরে বেড়িয়েছে কল্পিত স্বর্গের নন্দনকাননে, আর এপারে ঘুরে বেড়িয়েছে আমাদের পারিবারিক জীবনের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে। আমরা আমাদের কল্পনাকে কখনও বিরাট দেশের মধ্যে পরিব্যাপ্ত ক'রে দিতে শিথি নি আর এই কল্পনাশক্তির দৈন্তের জন্যই আমাদের সৰ্ব্বাঙ্গে আজ পরাধীনতার শৃঙ্খলভার। বঙ্কিমই প্রথম আমাদের চিত্তকে গৃহপ্রাচীরের গণ্ডী আর নির্বাণ-কামনার স্বল্প স্বার্থপরতা থেকে মুক্তি দিলেন স্বদেশের বিশালতার মধ্যে, আমাদের দৃষ্টির অস্পষ্টতা দিলেন ঘুচিয়ে আর আমাদের আঁখির সম্মুখে উদঘাটিত করলেন দেশজননীর রূপ । এই উদার নবজীবনের মধ্যে আমাদের চিত্তের যে মুক্তি—তারই স্বর বেজে উঠেছে বন্দেমাতরমের অমর সঙ্গীতের মধ্যে । মাৎসিনি যেমন ইটালীকে একরাজ্যভুক্ত করবার জন্য তার কানে দিলেন ইটালীয়ান রিপাব্লিকের মহামন্ত্র, বঙ্কিম তেমনি একই দেশাত্মবোধের প্রেরণায় সারা ভারতবর্ষকে অনুপ্রাণিত করবার জন্য তার কানে শোনালেন বন্দেমাতরমের গায়ত্ৰীগাথা । to বঙ্কিমচন্দ্র তার ঋষিদৃষ্টি দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন, ভারতবর্ষকে তার অশেষ দুৰ্গতি থেকে মুক্ত করতে হ’লে সৰ্ব্বাগ্রে চাই রাজনৈতিক স্বাধীনতা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব যদি জনসাধারণের চিত্তে দেশাত্মবোধ জীবস্ত হয়ে না-ওঠে। পারিবারিক জীবনের সঙ্কীর্ণ গওঁী থেকে তার চিত্তকে মুক্তি দিয়ে তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে স্বদেশের উদার লক্ষের মধ্যে। জন্মভূমির চরণপ্রান্তে শতধাবিভূক্তদেশকে ঐক্যের মধ্যে মেলাতে