পাতা:প্রবাসী (সপ্তত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).pdf/৯২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চৈত্র কাক কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে থাকেন। সম্পর্কটা অতি.নিকট হ’লেও পথের ব্যবধানটা বড় হয়ে চোখে ঠেকে, কাজেই যাওয়া-আসার মাত্রাটা আঙলে গুণে শেষ করা যায় অর্থাৎ কখন-সখন । কিন্তু ইদানীং লক্ষ্মীকে গান শেখাবার ভার পড়েছে আমার উপর । তা ছাড়া যাওয়া-আসারও একটা সুবিধাজনক ব্যবস্থা কাক ক’রে দিয়েছেন । লক্ষ্মীকে ভৈরবীর উপর একটা ভজন শেখাচ্ছিলাম। ওর তীক্ষু মেধা আমাকে বেশ আনন্দ দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে ভুল সংশোধন ক'রে ওকে উৎসাহিত ক’রে তুলছি। লক্ষ্মী পূর্ণ উদ্যমে গান অভ্যাস করছে এমন সময়টুকু এসে উপস্থিত হ’ল। আমার গায়ের উপর হেলে পড়ে এক গাল হেসে ঢিলে ছন্দে কথা ক’য়ে উঠল— দিদি কিছু পারে না-টুকু পরম বিজ্ঞের ন্যায় খানিক টেনে টেনে হেসে পুনরায় তার স্বভাবস্থলভ কণ্ঠে বললে— আমি দিদির চেয়ে ঢের ভাল পারি—টুচু হঠাৎ সঙ্গীতমুখর হয়ে উঠল। আমার দৃষ্টি এবং বোধ করি বা মনটাও জোর ক’রে তার দিকে আকৃষ্ট ক’রে উচ্চকণ্ঠে সা থেকে সা পৰ্য্যস্ত আবৃত্তি ক’রে গেল। টুচু সম্বন্ধে অনেক কথাই 'ইতিপূৰ্ব্বে শুনেছি, আজ তার সত্য রূপ খানিক দর্শন করলাম। করুণা হ’ল—আহা—আমি টুমুর দিকেই চেয়েছিলাম। ' টুম্ন উৎসাহিত হয়ে উঠল এবং সম্ভবতঃ আর একবার তার মেধার উৎকর্ষ সম্বন্ধে পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল; কিন্তু লক্ষ্মীর ধমকে সে থতমত খেয়ে গেল এবং হয়ত বা একটু সহানুভুতির আশায় বড় করুণ চোখে আমার দিকে চাইলে । সে-চোখে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ নেই বটে, কিন্তু ষে কাঙাল ভাব তার দুই সরল চোখে ফুটে উঠল তা আমাকে নাড়া দিলে । আমি লক্ষ্মীকে থামিয়ে দিয়ে বললাম—অবুঝ.ওর কোন কাজে দোষ হয় না। লক্ষ্মী লজ্জা পেলেও একটু হেসে বললে—সব সময় ভালও লাগে না । হয়ত লক্ষ্মীর কথাই ঠিক। মানুষের ধৈর্ষ্যের একটা সীমা আছে সে-কথাও অস্বীকার করা চলে না, তাই ব’লে জেনে-গুনে এই নিয়ে কথা বাড়ান কিংবা তাকে ধমক দেওয়ার সপক্ষে আমি কোন যুক্তি খুজে পেলাম না। ভালমন্দর জ্ঞান যার নেই তাকে নিয়ে, মিথ্য সময়ের অপচয় কেন ? ভাবলাম, যদি মিষ্টি কথায় ওকে নিরস্ত করা যায়। হেসে টুমুকে উদ্দেশ ক’রে বললাম-গানের সময় গোলমাল করতে নেই টুকু। চুপ ক'রে বসে, এর পরে তোমাকে বেশ ভাল দেখে একটা গান শেখাব ৷ অভাবনীয় 364 سty কথার ওজন বুঝবার ক্ষমতা ওর আছে, তার ধারা ,সম্বন্ধেও সচেতন দেখলাম, কিন্তু কোন বিষয়ই ওর মাখুয় বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না । আমার নরম স্বরে ফয় হ’ল উণ্টো। টুকু আমার আরও কাছ ঘেষে আৰআধ কণ্ঠে বললে—এখুনি শেখাও বড়দাদা— টুমুকে নিয়ে মিথ্য সময়ের অপচয় করব না ভেবেও নিজে থেকেই সেই ফাদে পা দিয়েছি। লক্ষ্মী পুনরায় টুম্বকে ধমক দিতে গিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেললে—অতটা সহজ হ’লে ভাবনা ছিল না বড়দা । * আমিও একটু হেসেই জবাব দিলাম—তাই ব’লে দিন রাত রক্ত-চক্ষু দেখানরও কোন মানে হয় না। তুমি গান শিখছ, ওরও ইচ্ছে হয়েছে। 彰 লক্ষ্মী বললে—ওর হবে না ষে— উত্তরে বললাম—তাই ব’লে ওর চেষ্টাকে তুমি দোষ দিতে পার না । লক্ষ্মী নীরব হ’ল, কিন্তু টুচু কিছুতেই নিষ্কৃতি দিতে প্রস্তুত নয়। তার গান শিখবার ইচ্ছেটা শেষ পর্য্যস্ত একটা জেদে পরিণত হয়েছে । আমি বিত্রত হয়ে পড়লাম। লক্ষ্মী বেশ উপভোগ করছিল, তার চোখমুখের ভাব দেখে পরিষ্কার বোঝা গেল। কিন্তু পাছে আমার জ্যেষ্ঠত্বকে অপমান করা হয়, সম্ভবত এই আশঙ্কায় তা প্রকাশ-পথে বার বার বাধা পাচ্ছিল । টুচু বলছিল—জান বড়দাদা, দিদি একটুও ভাল না...আমাকে ভালবাসে না। যুঁই না, নীলা না, হাসি না-কেউ না... আমি একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম। ভয় হ’ল, কি জানি টুচু হয়ত কেঁদে ফেলবে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত ক’রে দিয়ে টুচু হাসতে লাগল। এ হাসিতে চোখের জল ছিল না, কিন্তু বেদনা ছিল, অথচ এ-খবর ঐ মেয়েট হয়ত জানে না। জানে না যে, ওরু এই হাসির ভিতর দিয়ে সাধারণ জীবনের দৈন্য কেমন ক’রে মামুষের চোখে ধরা দেয় । ওর এই অৰ্দ্ধচেতন মনের বিকাশগুলি আমাকে যুগপৎ ব্যথিত এবং আগ্রহাতি ক'রে তুলছিল। ওকে জানবার এবং বুঝবার জন্য মনের মধ্যে একটা তাগিদ এল। 'ষে অবহেলা ঐ অবোৰ মেয়েটা দিনের পর দিন পেয়ে আসছে লক্ষ্মীর কাছ থেকে, যুঁইয়ের কাছ থেকে, নীলার কাছ থেকে, এমন কি সৰ্ব্বকনিষ্ঠ হাসির কাছ, থেকেও, সে কথাটা ও জানে, উপলব্ধি করে অথচ প্রতিবাদ করতে পারে না ।