৩য় সংখ্যা ] লাটের স্পেশাল ○○○ পিছাইয়া গিয়া কহিল, “সাঝের আগে ফিরূবে বাবা, জানলে ?” পুত্রের শঙ্কাবিহ্বল দৃষ্টি দেখিয়া বেণু কহিল, “সাঝের আগেই ফিরব মনাই, তুই ঘরে যা|” তাছার পর পুত্রকে একটি চুমা দিবার অভিপ্রায়ে দুইহাত বাড়াইয় তাহাকে বুকে তুলিতে যাইতেছিল, এমন সময় পিছনে দফাদার কহিয়া উঠিল, “পথে দাড়িয়ে আর দেরী কোরোন, সর্দারের পো, বেলা ভাটিয়ে আসছে।” অগত্যা মাথা নীচু করিয়া পুত্রের গালে তাড়াতাড়ি একটা চুমা দিয়া বেণু কহিল,“ঘরে যা মনাই তোর মা পিঠে নিয়ে বসে আছে।" পিঠার কথা শুনিয়া সে ছিপগাছি তুলিয়া লইয়া বিনাবাক্যে বাড়ীর পথ ধরিল এবং কিছুদূর গিয়া গলির মোড়ের বেত-ঝোপের আড়াল হইতে মুখ বাহির করিয়া পিতাকে অবশু অবশু সন্ধ্যার পূর্বে ঘরে ফিরিবার জন্য দ্বিতীয় বার উপদেশ দিয়া গেল । ( R ) শীতের ছোট শেব বেলাটি অনেকক্ষণ পূৰ্ব্বেই শেষ হইয়া গিয়াছে। প্রতি চল্লিশ হাত অস্তর চৌকীদার নাম ধারী এক-একটি মানব-সন্তান লাঠি ঘাড়ে করিয়া লাটের স্পেশালের প্রতীক্ষায় দাড়াইয়া থোলামাঠের তীব্র হাওয়ায় শীতে কঁাপিতেছিল। গাড়ী আসিবার সময় ছিল সন্ধ্যায়, কিন্তু রাত্রি, প্রহর উত্তীর্ণ হইয়া গেল গাড়ী তখনও আসিল না। বেণু অধীর হইয়া উঠিল । দিব্য চক্ষে সে দেখিতে পাইল, পাথরের থালায় সরুচাকৃলি সাজাইয়া এতক্ষণে বিরাজ প্রদীপ জালিয় তাহার প্রতীক্ষা করিতেছে। বেণু জিজ্ঞাসা করিল, "গাড়ীর খবর কি, দফাদার দ৷ ” দফাদার নিজেও বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল, কহিল, “মালিক হুজুরের হুকুম তামিল করতে এসেছি। থান থেকে ক’লে দিলে সাঝ বেলায় যাবে গাড়ী, এখন তো রাত এক পহর। কঁথাখানাও জানিনি।” দফাদার মাথার পাগড়ী খুলিয়া গায়ে জড়াইল । শীত তখন ক্রমেই তীব্র হইয়া উঠিতেছিল। - বস্তুতঃ গাড়ী ছাড়িবার সময় ঘণ্টা পাচেক পিছাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু গগুগ্রামের চৌকীদারের কাছে সে সংবাদ পৌঁছে মাই। এমন সময় মেঘ করিয়া আসিল । চৌকীদারের দল প্রমাদ গণিল । ইহার পর যদি বৃষ্টি আরম্ভ হয় তাহা হইলে প্রাণ লইয়া গৃহে ফেরা অসম্ভব, এ কথা দফাদারকে স্পষ্টভাষায় জানাইতে কেহই দ্বিধা করিল না। দফাদার একটি ছোট পুটুল উচু করিয়া ধরিয়া কহিল ; “শীতের ওষুধ সঙ্গে নিয়ে এসেছি । আয় দেখি ” ইঙ্গিতটা সকলেই বুঝিল, পাচ সাত মিনিটের মধ্যে “বোম্ বোম্ ভোলানাথ” শব্দে স্থানটি মুখর হইয়া উঠিল এবং গঞ্জিকার ধূমে অন্ধকার আরও জমাট বাধিয়া গেল । দফাদার ডাকিল, “সর্দারের পো, কোথায় গা ?” - বেণু জবাব দিল "উচ্ছ। আমি খাব না, দফাদার দা ।” এক কালে সে পুরাদস্তুর গঞ্জিকা-সেবী ছিল কিন্তু বৎসর তিনেক হইল বিরাজ তাহীকে তাহার শাখা পিকুরের দিব্য দিয়া নেশা ছাড়াইয়াছে ; সেই অবধি বেণু গাজার কলিকা স্পর্শ করে নাই। শীতের ওষুধ সেবন করিয়া চৌকীদারের দল কিছুক্ষণের জন্ত নিস্তব্ধ হইল। কেবল মাত্র বেণু দুই হাটু মুড়িয়া তাহার উপর মুখ রাথিয়া শীতে ঠক্ ঠক্ করিয়া কঁাপিতে লাগিল । হস্ ! ইস্ ! “উঠে দাড়া সব। লাঠি ঘাড়ে ঠিক হয়ে সাম্নে চেয়ে থাকৃ।” দফাদার হাকিল । হস্ ! ইস্ ! গাড়ী চলিয়া গেল-মাল-গাড়ী । বিরক্ত হই। চৌকীদারের অদৃষ্টকে অভিসম্পাত মিল। দফাদার কহিল, "শীতের ওষুধ আর একবার তৈরী করে’ নাও দেখি, শীত ভয়ে ভাগবে ।” ঔবধ সেবন চলিতে থাকিল, দূর হইতে বেণু ধুমকুণ্ডলীর দিকে চাহিয়া রহিল, নড়িল না। রাত্রি দশটায় দুই এক ফোটা বৃষ্টি পড়িল । বেণু কোনো ক্রমে উঠিয়া দাড়াইয়া দেখিল যে, সঙ্গীরা চার পাঁচ জন করিয়া - কুগুলী পাকাইয়া ভূমি-শধ্যায় আশ্রয় লইয়াছে। বেণুর মনে হিংসা হইল। সৰ্ব্বাঙ্গ তখন অসন্ত শীতে আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছিল ; পদতলের পাথরের কুড়িগুলি মনে হইতেছিল বরফের টুকরার মত। কিছু দূরে তারের
পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৫০
অবয়ব